ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

খোয়াই নদীর পাড়ের শায়েস্তাগঞ্জ হাই স্কুল

আনোয়ার ফারুক তালুকদার শামীম

প্রকাশিত : ০৮:২৫ পিএম, ১০ মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার

শায়েস্তাগঞ্জ হাই স্কুল খরস্রোতা খোয়াই নদীর পাশে স্থাপিত। স্কুলের পাশ দিয়ে চলমান ঢাকা-সিলেট রেলপথ। এই অঞ্চলে শতবর্ষব্যাপী শিক্ষার আলো বিকিরণকারী আমাদের প্রাণপ্রিয় বিদ্যালয়। এটি আলোকিত মানুষ তৈরির কারখানা। স্মৃতির পাতায় চিরজাগ্রত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল বর্তমানে ইতিহাসের নানা গলিপথ বেয়ে সময়ের পরিক্রমায় শতবর্ষ পূর্ণ করল। ১৯৮৩ সালে উলুকান্দি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পা বাড়িয়েছিলাম যে স্কুলে তা ২০১৮ সালে শতবর্ষী হতে চলেছে। অসংখ্য গুণীজন তৈরির এই সূতিকাগারের সাথে জড়িয়ে আছে আমার শৈশব আর কৈশোরের অসংখ্য স্মৃতি।

গ্রামের আলপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হতো স্কুলে। যাওয়ার পথে ছোট একটি খাল পার হতে হতো। এটাতে ছিল বাঁশের সেতু। সেতুটা প্রায়ই নড়বড়ে থাকত। দুরু দুরু বুকে পার হতাম সেই পুলসেরাত। কতবার এটি পার হতে গিয়ে ছোট নদীতে পড়ে গেছি, তাও স্মৃতির মণিকোঠায় আঁচড় কাটছে। আমাদের ছোট নদীতে বৈশাখ মাসে হাঁটুজলই থাকত। এখন উপজেলা পরিষদের কল্যাণে ছোট নদীর ওপর একটি সেতু হয়েছে। এখন আমার মতো আর কোন স্কুলের বাচ্চাকে পানিতে পড়তে হয় না। বর্ষাকালে কখনো কখনো বন্যার প্রবল স্রোতের মধ্যে লুঙ্গি মাথায় নিয়ে পানি অতিক্রম করেছি। এমনই একসময় স্রোতের জলে ভেসে গিয়েছিল আমার বইখাতা। স্মৃতির পাতায় আজও এগুলো অম্লান। প্রথমদিকে খুব একটা ভালো ছাত্রের তকমা না থাকলেও শেষদিকে তথাকথিত ভালো ছাত্রই ছিলাম বটে। জীবনে একবার দশম শ্রেণিতে বন্ধু আমজাদ হোসেনের (বর্তমানে ম্যানেজার, ফিনলে টি এস্টেট) সাথে যুগ্মভাবে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলাম।

আমার জীবনে এটাই সর্বোচ্চ ভালো ফল। তবে আজ যাদের নাম দেখছি এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রের তালিকায়, সেই গুণীজনদের দেখে নিজের ভালো ছাত্রত্ব জাহির করতে বেশ লজ্জা লাগছে। বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি জেআর মোদাচ্ছির হোসেন, ড. এসএ মজিদ, এসএস মিজানুর রহমান, বাবু অশোক মধাব রায়ের সাথে বন্ধু ব্যারিস্টার তারেক চৌধুরীর নাম দেখতে পেয়ে সত্যিই আমি গর্বিত। আমার জানা ছিল না এত বড়মাপের ব্যক্তি জন্ম দিয়েছে গ্রামের এই স্কুল। আমাদের বন্ধুদের অনেকেই আজ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাদের উপস্থিতি সগর্বে ঘোষণা করছেন। তাদের সাথে পড়ালেখা করেছি কিংবা একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম, তা ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করছি। শায়েস্তাগঞ্জ স্কুলের ইতিহাস বললে যে নামটি ছাড়া স্কুল অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তিনি হলেন দীর্ঘ সময়ের প্রধান শিক্ষক আবদুন নূর চৌধুরী। তিনি একাধারে আমাদের শিক্ষক ও পিতার দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই এলাকার আলোকবর্তিকা হিসাবে আগমন ঘটেছিল ক্ষণজন্মা এই মানবের। তিনি দশম শ্রেণিতে আমাদের অংক ক্লাস নিতেন। আমি অংকে একটু ভালো ছিলাম বলে প্রায়ই আমাকে দিয়ে অংক করাতেন। আমি সেটা সানন্দে করে যেতাম। আসলে কি সানন্দে? তার ভয়ে সদা আমরা তটস্থ থাকতাম। আমাদের মহেশবাবু স্যারের কিলের কথা আমাদের সমকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভোলার কথা নয়। আমাদের কাছে খনার বচনের মতো ছিল ‘মহেশ্বর স্যারের কিল আর বৈশাখ মাইয়া হিল’। বিপদবরণ স্যার সর্বদাই অনেকের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতেন। ক্রীড়ামোদী রহিম স্যারের মায়াময় চাহনিযুক্ত চোখ আজও তেমনি মনে পড়ে। ধর্মশিক্ষক আবু তাহের স্যারের কল্যাণে আমাদেও অনেকেরই নামাজ পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। নৃপেন্দ্র স্যারের রুচিশীলতা আমায় মুগ্ধ করতো। প্রিয় শিক্ষকদের অনেকেই আজ আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি দিয়েছন। মহান আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তাদের বেহেশতবাসী না করে পারবেন না। এত ছাত্রছাত্রী যারা আলোকিত করে রেখে গেছেন, তাদের অবস্থান বেহেশত ছাড়া অন্য কোথাও হতে পারে না। বন্ধুদের অনেকের সাথে আধুনিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু এখনো অনেককে খুঁজে বেড়াই। আশা করি, স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে অনেকের সাথে দেখা হবে।

লেখক:১৯৮৮ ব্যাচের ছাত্র ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট সীমান্ত ব্যাংক