ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

কোটা আন্দোলন যৌক্তিক : শান্তনু মজুমদার

প্রকাশিত : ০৭:১৫ পিএম, ১৩ মে ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০২:২২ পিএম, ১৭ মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার

ড. শান্তনু মজুমদার

ড. শান্তনু মজুমদার

বিসিএসসহ সব ধরণের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের একপর্যায়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেছে। কিন্তু বেশ কিছু দিন অতিবাহিত হলেও কোটা বাতিলের ব্যাপারে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে কাটছে চাকরি প্রত্যাশী লাখো তরুণের সময়।

এ পরিস্থিতিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, চাকরিতের প্রবেশের বয়সসীমা, গ্রাজুয়েশনের পরও চাকরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, পাবলিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদারের। কোটা ছাড়াও তিনি কথা বলেছেন প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা, কোচিং বাণিজ্য, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানসহ নানা বিষয়ে।  

দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা ব্যবস্থা নিয়ে আপনার মত কি?

শান্তনু মজুমদার : আমি কোটার পক্ষের মানুষ। নানান কারণে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বাকিদের কাতারে নিয়ে আসার জন্য এই ব্যবস্থা দরকার। এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একান্ত অংশ। আবার এটাও ঠিক যে, বাস্তবতার নিরিখে সময়ে-সময়ে কোটা পদ্ধতি সংস্কার হওয়া দরকার। আর সে সংস্কার হওয়া দরকার সুচিন্তিত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে; চাপের মুখে নয়। কোটা থাকতেই হবে। কিন্তু এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে যে সমাজের কোনো অংশের জন্যই কোটা কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। 

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা পদ্ধতি সংস্কারে জোর দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন। আসলে কোটার সংস্কারটা কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

শান্তনু মজুমদার : আমি যদি বুঝে থাকি তাহলে কোটা সংষ্কারপন্থীদের মূল দাবি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংষ্কার করা। মানে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা বরাদ্দ করা আছে তা সংষ্কার করা। এই সংষ্কারের দাবি মুক্তিযোদ্ধা কোটার হার কমিয়ে আনার নাকি মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলে ফেলার তা আমি নিশ্চিত নই। দু’টো কিন্তু দুই ব্যাপার।    

আমার মনে হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে ৩০ শতাংশ কোটা আছে সেটা বেশি। আবার এটাও সত্য যে, বিগত বছরগুলোতে কখনোই  মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ কোটার পুরোপুরি ব্যবহার হয়নি। একই সঙ্গে এটাও চরম লজ্জার যে, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন। ইউরোপের দিকে তাকাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া কোনো সৈনিক মারা গেলে তা এখনো বড় খবর হয়। এরা জাতীয়ভাবে পূজিত। এঁদের জন্য রাষ্ট্রের দ্বার অবারিত। আমরা তো এর ধারেকাছেও নেই। এখন রাষ্ট্র যদি বিসিএস বলুন বা অন্য কোনোভাবে বলুন কিছুটা দায় লাঘব করতে চায়, ক্ষতি কি? তবে ক্যাডারভিত্তিক চাকরির ক্ষেত্রে এটা একটা টোকেনের মত থাকাটাই ভালো। ধরা যাক, পাঁচ শতাংশ। তবে, মুক্তিযোদ্ধারাই কি সব পাবে? আমরা কি কিছুই পাব না? এ ধরণের কথাবার্তার রাজনীতিটা সুবিধার মনে হয় না।

আমার মত হচ্ছে, কোটা বাতিলের প্রশ্নই উঠে না। কিন্তু কোটা সংষ্কার হচ্ছে স্বাভাবিকতা। কেবল মুক্তিযোদ্ধা কোটা নয় যেখানে দরকার সেখানেই সংষ্কার হতে পারে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, আদিবাসী কোটা, জেলা কোটা যাই হোক। সংস্কার মানে কেবল কোটা কমানো তা নয়, বিশেষজ্ঞরা যদি মনে করেন কোন একটা জায়গায় বাড়াতে হবে তাহলে বাড়বে। কথা হচ্ছে, সরকারি চাকরিকেই যেন আমরা মেধা-ধারণের একমাত্র জায়গা মনে না করি।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটার এ আন্দোলনকে অনেকে বিশেষ মহলের ইন্ধন বলছেন।  আবার অনেকে এটাকে সাধারণ ছাত্রদের দাবি বলে দাবি করছেন। বিষয়টি আপনার কাছে কি মনে হয়?

শান্তনু মজুমদার: যে ছেলেটি বা মেয়েটি জীবনে কোনোদিন জাতীয় স্বার্থে মাঠে নামেনি এবার সেও মাঠে আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের যে ছেলেটির জন্য বিএসএস উত্তীর্ণ হওয়া এককথায় অসম্ভব, সেই ছেলেটিও সড়ক আটকে আন্দোলন করছে। কোটার কারণে, আমি যদি ভুল না বুঝি, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার কারণে ভবিষ্যত ফিকে হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে এদের। এই মন:স্তত্ত্বকে কেবল ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না। কিংবা ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাগ্রস্ত এসব তরুনদের মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে পুরো ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। ষড়যন্ত্র থাকবে না কেন? আছে তো। মুক্তিযুদ্ধকে ডিসক্রেডিটেড করার প্রচন্ড শক্তিশালী একটা মেশিনারি পঁচাত্তরের হত্যাকান্ডের পর থেকেই কাজ করছে। এই আন্দোলনে এদের সক্রিয় না থাকার কারণ দেখি না।

কিন্তু তারপরেও বলবো এই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ব্র্যান্ড দেওয়া ঠিক হবে না। আন্দোলনকারীরা সবাই কিন্তু একরকমের মানসিকতার মানুষ নয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে যথাযথ আবার কখনো অযথা বাড়াবাড়ি-দুশ্চিন্তা, পরিবারের স্বপ্ন বা পরিবারের বাড়াবাড়ি চাপে ভুগতে থাকা কিংবা ক্যারিয়ার বলে নামক শব্দের সঙ্গেই একমাত্র মিতালী করা– এরকম নানা রকমের মানুষ আছে আন্দোলনে। সরকারি চাকরিকেই জীবনের মোক্ষ মনে করে এরকম মানুষ আছে। এর বাইরে শ্রুত হতে চায় এরকম মানুষও আছে। অর্থ্যাৎ এরা চায় কর্তৃপক্ষ তাদের যুক্তিটি মন দিয়ে শুনুক।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে ছাত্রদের এ দাবি আপনি কিভাবে দেখছেন?

শান্তনু মজুমদার: ভারতে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা কোটা বিরোধী আন্দোলন করে। তারা দাবি করে যে, ভারতীয় রাষ্ট্র কোটা সুবিধার মাধ্যমে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও অ-হিন্দু, বিশেষ করে মুসলিমদের নির্বিচারে চাকুরি দিয়ে যাচ্ছে। এরা কথায়-কথায় মেধা-কার্ড খেলে। কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি ভিন্ন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কথা বলেছেন। সে কারণে ছাত্ররা আন্দোলন স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলেও এখনও সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। বিষয়টির সমাধান কোন দিকে যাচ্ছে?

শান্তনু মজুমদার : এটার ভবিষ্যৎ আসলে স্পষ্ট নয়। এখানে আমার কথা হলো তাদের দাবি যৌক্তিক কি না? যদি যৌক্তিক হয়, তবে সেটা সমাধান করা হোক। একই সঙ্গে আমি মনে করি সংখ্যাগরিষ্ঠতা সবসময় ন্যায্যতা নির্ণয় করতে পারে না।  সুতরাং অভিমান করে, চাপের মুখে বা ভোটের মুখে নয়, কোটা ব্যবস্থার একটা যৌক্তিক সংষ্কার দরকার ন্যায্যতার ভিত্তিতে এবং অবশ্যই বিশেষজ্ঞদের দ্বারা যথাযথ বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে।

 

/ এআর /