‘কোটা শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত’
প্রকাশিত : ০৭:১০ পিএম, ১৪ মে ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০১:৫১ পিএম, ১৯ মে ২০১৮ শনিবার
অধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমদ
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার এক মাস পেরিয়ে গেছে। আজও কোটা বাতিল বা সংস্কারের বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে আশা-নিরাশার দোলাচলে কাটছে চাকরি প্রত্যাশী লাখো তরুণের সময়। তাই প্রজ্ঞাপন দাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বাদ দিয়ে ফের রাজপথে নেমে এসেছে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীরা।
এ পরিস্থিতিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, চাকরিতের প্রবেশের বয়সসীমা, গ্রাজুয়েশনের পরও চাকরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, পাবলিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য অ্ধ্যাপক ড. আবুল মনসুর আহমেদের।
একুশে টেলিভিশন অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কোটা পুরোপুরি বাতিল করার পক্ষে আমি না। বরং এটা সংস্কার করা যেতে পারে। আমার মনে হয় সংস্কারের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে আনা যেতে পারে। নারী কোটা কমিয়ে অর্ধেকে আনা যেতে পারে। আদিবাসী কোটাও কমানো যেতে পারে। তবে জেলা কোটা পুরোটাই বাদ দেওয়ার পক্ষে আমি। এসব সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগটা ৮০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ হতে পারে। আর কোটার নিয়োগ থাকতে পারে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। কোটা সংস্কার দাবিতে ছাত্রদের যে আন্দোলন তা যৌক্তিক বলে মনে করেন তিনি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো-
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা পদ্ধতি সংস্কারে জোর দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন। আসলে কোটার সংস্কারটা কিভাবে হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
আবুল মনসুর: দেশ স্বাধীনের পর যে কোটা পদ্ধতি চালু হয়েছিল। আজকের এ পরিস্থিতিতে সেটা সংশোধন বা পরিমার্জন করা দরকার বলে আমি মনে করি। কেননা বর্তমানে দেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ৫৬ শতাংশ হয় কোটার ভিত্তিতে, আর ৪৪ শতাংশ হয় মেধার ভিত্তিতে। অথচ আমাদের দেশে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত জনশক্তি চাকরির বাজারে ঢুকছে। সেক্ষেত্রে নিয়োগের বিষয়ে মেধাবীদের জায়গাটা আর একটু বেশি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করা দরকার বলে মনি করি।
মেধাবীদের বিষয়ে সেই চিন্তার জায়গা থেকে কোটা পুরোপুরি বাতিল করার পক্ষে আমি না। বরং এটা সংশোধন করা যেতে পারে। আমার মনে হয় সংস্কারের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে আনা যেতে পারে। নারী কোটা কমিয়ে অর্ধেকে আনা যেতে পারে। আদিবাসী কোটাও কমানো যেতে পারে। তবে জেলা কোটা পুরোটাই বাদ দেওয়া যেতে পারে। প্রতিবন্ধী কোটাও কিছুটা কমিয়ে আনা যেতে পারে। এসব সংযোজন বিয়োজনের মাধ্যমে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগটা ৮০ শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ হতে পারে। আর কোটার নিয়োগ থাকতে পারে ১৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কোটা বাদ দিলে হবে না। এটা পরীক্ষা-নিরিক্ষা ও যাচাই-বাঁছায়ের মাধ্যমে কমিয়ে আনা যেতে পারে।
তাই কোটা সংস্কারে ছাত্রদের যে সংস্কারের দাবি উঠে আসছে এটা যৌক্তিক বলে আমি মনে করি। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশটা ছোট। এর সম্পদের পরিমানটাও সীমিত। এই সীমিত সম্পদের যদি সমবণ্টন করতে যায়, তবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার নাতি-নাতনী পর্যায়ে গেলে ঠিক হবে কী না এটা ভাবার বিষয় রয়ে গেছে বলে আমার মনে হয়। আমি মনে করি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারলে ভালো হতো।
এখানে আরও একটা বিষয় দেখা যেতে পারে যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় একবার যে সুবিধা নিবেন, সে যেন দ্বিতীয়বার না নিতে পারে। এটা করা হলে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পরবর্তীরা সুবিধা নিতে পারবেন না। যে ব্যক্তি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটার সুবিধা নিচ্ছে, সে চাকরি ক্ষেত্রে একই সুবিধা নিতে পারবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা বাদ দেওয়ার কথা বলেছেন। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?
আবুল মনসুর: প্রধানমন্ত্রী এটাকে বাতিলের কথা বলেছেন। আমরা দাবি রাখবো এটাকে পুরো বাতিল না করে, কিভাবে সংশোধীত আকারে নিয়ে আসা যায় সেটা ভেবে দেখার। যাতে কোন পক্ষই ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: প্রধানমন্ত্রী কোটা বাদ দেওয়ার কথা বলার পর বেশকিছু দিন পেরিয়ে গেল। এখনও প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ হতাশ হয়ে পড়ছেন। বিষয়টিকে কিভাবে দেখবেন?
আবুল মনসুর: ছাত্রদের দাবি যৌক্তিক মেনেই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের প্রতি সবাইকে শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। কারণ একটা পদ্ধতি বাতিল করার সিদ্ধান্তে গেলে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যেতে হয়। এ প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করতে সময় লাগতে পারে। সরকারকে সে সময় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী সংসদে এটা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তো গুরুত্বের বিবেচনায় এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া উচিত।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: ছাত্রদের অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সংসদের ঘোষনা দিয়েছেন, সেহেতু এটা এক প্রকার আইনে পরিণত হয়ে গেছে। এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করতে কোন বাঁধা থাকতে পারে না। আসলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এটা আটকে রাখা হচ্ছে। ছাত্রদের এ অভিযোগের সঙ্গে আপনি কি একমত?
আবুল মনসুর: ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলবো এটার জন্য সময় দেওয়া উচিত। কারণ এরই মধ্যে একটি কমিটি করে প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। আমার বিশ্বাস এ কমিটি খুব দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন দেবে এবং সে প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের প্রকাশ ঘটানো হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে উপাচার্যের বাসভবনে ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছিল। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
আবুল মনসুর : শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নামে এই যে ভাংচুর এটার পক্ষে আমি নই। দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে, কিন্তু সেটা হবে শান্তিপূর্ণভাবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবনে যে হামলা, ভাংচুর হয়েছে, এটা নজিরবিহীন।এটা কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না।উপাচার্যের বাসভবনে হামলা এর আগে কখনও ঘটেনি। আমরা এ ঘটনায় যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি চাই।যে বা যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায আনা হোক এটাই আমাদের কাম্য।
/ এআর /