ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

গোল্ডেন বল, বুট ও গ্লাভস ট্রফি যেভাবে বিশ্বকাপে

প্রকাশিত : ০৪:৫৮ পিএম, ২৩ মে ২০১৮ বুধবার

দরজায় কড়া নাড়ছে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর ফুটবল বিশ্বকাপ। কয়েকদিন পরেই শুরু হচ্ছে এই আসর। এই আসরকে ঘিরে ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনার শেষ নেই। আর ১৯৩০ সাল থেকে দুনিয়ার সব ফুটবল পরাশক্তিদের নিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল আসর প্রতি চার বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। টুর্নামেন্টে সেরা দল অর্জন করে বিশ্বকাপ এবং প্রতি আসরের সেরা খেলোয়াড়দের সম্মানিত করা হয় বিভিন্ন ব্যক্তিগত পুরষ্কারে। ১৯৩০ সাল থেকে বিশ্বকাপ শুরু হলেও ব্যক্তিগত পুরষ্কারের প্রবর্তন হয় ১৯৮২ সালে। ফিফা ১৯৮২ সাল থেকে ‘গোল্ডেন বল’ ও ‘গোল্ডেন বুট’ পুরস্কারের রেওয়াজ চালু করে। সেই ১৯৮২ সালে ইতালির পাওলো রসি থেকে শুরু করে এই প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি বিশ্বকাপের ব্যক্তিগত পুরষ্কার সাজিয়েছেন নিজেদের শোকেসে। আসুন এক নজরে দেখে নেই ব্যক্তিগত পুরষ্কারজয়ী বিশ্বকাপ মাতানো তারকাদের। তার আগে জেনে নেই কি কি ব্যক্তিগত পুরষ্কার প্রদান করা হয়।

গোল্ডেন বল
প্রতি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে পুরষ্কৃত করা হয় গোল্ডেন বল পুরষ্কারে। ১৯৮২ সালে প্রথমবার গোল্ডেন বল প্রদান করা হয়।
গোল্ডেন বুট
প্রতি বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতাকে এই গোল্ডেন বুট পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। গোল্ডেন বলের মত ১৯৮২ সালেই সর্বপ্রথম সর্বোচ্চ গোলদাতাকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। যদি একাধিক সংখ্যক খেলোয়াড় সমান গোল করে, তাহলে অন্যকে গোল করতে সহযোগিতা ও খেলার সংখ্যা বিবেচনায় এনে গোল্ডেন বুট প্রদান করা হয়।

গোল্ডেন গ্লাভস
প্রতি বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষককে এই পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। যদিও এই পুরস্কারের বয়স বেশি না ১৯৯৪ সালে প্রয়াত লিজেন্ডারি সোভিয়েত গোলকিপার লেভ ইয়াসিনের স্মরণে এই পুরস্কার প্রদানের প্রচলন করা হয়। ফিফা টেকনিক্যাল কমিটি পুরো আসরের গোলকিপারদের পারফরমেন্স বিবেচনা করে এই পুরস্কার দিয়ে থাকে। যদিও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার গোল্ডেন বলের জন্যেও গোলকিপাররা মনোনীত হয়ে থাকেন, যেমন ২০০২ সালে জার্মান গোলরক্ষক অলিভার কান গোল্ডেন বল জিতেছিল। লেভ ইয়াসিন এওয়ার্ডকে পরবর্তীতে ২০১০ সালে গোল্ডেন গ্লাভস নামকরণ করা হলেও লেভ ইয়াসিন এওয়ার্ড হিসেবেই বেশি পরিচিত।

১৯৮২ স্পেন বিশ্বকাপ
স্পেন বিশ্বকাপেই শুরু হয় ব্যক্তিগত পুরষ্কারের প্রচলন ও প্রথমবারেই একই সঙ্গে গোল্ডেন বল এবং গোল্ডেন বুট জয়ের অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন ইতালীয় লিজেন্ড পাওলো রসি। এই বিশ্বকাপে পাওলো রসি ছয় গোল করে গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট জেতেন এবং ইতালির তৃতীয় বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে। তখনও গোলকিপারদের আলাদা কোনও ব্যক্তিগত পুরষ্কার দেয়ার রেওয়াজ ছিল না।

১৯৮৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ
ফুটবলের বরপুত্র হিসেবে পরিচিত আর্জেন্টাইন যুবরাজ ডিয়াগো ম্যারডোনা সেবার তার জাদুকরী খেলা বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছিলেন। সেই আসরে ডিয়াগো ম্যারাডোনা গোল্ডেন বল জিতলেও ইংলিশ ফুটবলার গ্যারি লিনেকার তার ব্যক্তিগত নৈপূণ্য প্রদর্শন করে ৬ বার প্রতিপক্ষের জালে বল পাঠিয়ে গোল্ডেন বুট জয় করেন।

১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ
ইতালীয় আক্রমণভাগের খেলোয়াড় সালভাতর শিলাচির আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যা মাত্র ৭টি। এর মধ্যে ৬টি গোল তিনি এই ইতালি বিশ্বকাপেই করেছিলেন। এই আসরে ব্যক্তিগত পুরষ্কার জয়ের ক্ষেত্রে তিনি ম্যারাডোনা, লুথার ম্যাথিউসের মতো তারকাদের পেছনে ফেলেন। পশ্চিম জার্মানির ক্যাপ্টেন ম্যাথিউস সেবার বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে তুললেও ছয় গোল করে গোল্ডেন বল ও গোল্ডেন বুট দুইই জিতে নেন সালভাতর শিলাচি।

১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ
রবার্তো ব্যাজিও যদি তার শেষ পেনাল্টিকে মেঘের দেশে না পাঠাতেন তাহলে সেই আসরে গোল্ডেন বল হয়তো সঙ্গে করে তিনি ঠিকই নিজের বাসায় ফিরতেন। তার ভুলের খেসারত হিসেবে, ব্রাজিল জিতে নেয় বিশ্বকাপ আর সেই আসরে ছয় গোল করে গোল্ডেন বল জয় করে নেন ব্রাজিলীয় তারকা রোমারিও। কিন্ত বিশ্বকাপ জিতলেও তাদের দলের কেউই গোল্ডেন বুট জিততে পারেনি। রাশিয়ার অলেগ সালেনকো এবং বুলগেরিয়ার হ্রিস্টো স্টোইচকোভ দুই জনই ৬ গোল করে সেবার যৌথভাবে গোল্ডেন বুট জয় করে নেন। আর এই আসরে বেলজিয়ামের গোলরক্ষক মাইকেল প্রুডহোম অবিস্মরণীয় প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গোল্ডেন গ্লাভস তথা তৎকালীন ইয়াসিন এওয়ার্ড জয় করেন।

১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপ
মাত্র চার গোল করেও ব্রাজিলীয় তারকা রোনালদো গোল্ডেন বল জয় করে নেয়। ফাইনালে ৩-০ গোলে ফ্রান্সের কাছে হেরে যাওয়ার পরেও ‘ফেনোমেনন’ রোনালদো সেই আসরে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার গোল্ডেন বল জয় করেন। অন্যদিকে ক্রোয়াট স্ট্রাইকার ড্যাভর সুকার ছয় গোল করে গোল্ডেন বুট জয় করেন এবং ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন গোলরক্ষক ফ্যাবিয়েন বারথেজ, যা তাকে ইয়াসিন এওয়ার্ড জিততে সাহায্য করে।

২০০২ জাপান-কোরিয়া বিশ্বকাপ
একবিংশ শতকের প্রথম বিশ্বকাপে একজন গোলকিপারের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হওয়া সত্যি এক অভাবনীয় বিষয়। সেই আসরে অলিভার কান তার অতিমানবীয় পারফরমেন্সের মাধ্যমে ফাইনালের আগ পর্যন্ত নিজেদের রক্ষণভাগকে দুর্ভেদ্য দেয়াল করে রেখেছিল। যদিও ফেনোমেনন হিসেবে খ্যাত ব্রাজিলীয় রোনালদো শেষ পর্যন্ত সেই দুর্গে ফাটল ধরিয়ে ব্রাজিলকে পঞ্চমবারের মত বিশ্বকাপ জিততে সাহায্য করেছিল। রোনালদো আট গোল করে গোল্ডেন বুট জিতলেও, সেই আসরে একই সঙ্গে গোল্ডেন বল ও লেভ ইয়াসিন এওয়ার্ড দুইই জয় করে নেয় অলিভার কান।

২০০৬ জার্মান বিশ্বকাপ
মার্কো মাতোরেজ্জির বুকে সেই আঘাতটি না করলে সেই আসরের ফলাফলই হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। পুরো আসরজুড়ে সাবেক ফ্রান্স কাপ্তান জিনেদিন জিদান যেমন পারফরমেন্স দেখিয়েছিলেন, সেই আসরে গোল্ডেন বলের জন্য তেমন কোনও দাবিদার ছিল না। ইতালি নিজেদের চতুর্থ বিশ্বকাপ জিতে নিলেও রানার্সআপ দলের জিদান গোল্ডেন বল জিতে নেন। অন্যদিকে জার্মান তারকা মিরোস্লাভ ক্লোসা সবথেকে বেশি ৫ গোল করে গোল্ডেন বুট জয় করেন।

২০১০ সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপ
সেই বিশ্বকাপে দুনিয়া পরিচিত হয় ভুভুজেলার সঙ্গে আর সাক্ষী হয় তিকিতাকার এবং অন্য সব দলের ওপর স্পেনের আধিপত্য। সেবার বিশ্বকাপের সেরা দল হওয়ার লড়াই ছাড়াও ব্যক্তিগত পুরষ্কারের জন্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলে। গোল্ডেন বুট বিজয়ী থমাস মুলারের সমান গোল করেন আরো তিনজন; নেদারল্যান্ডের ওইয়েসলি স্নাইডার, স্পেনের ডেভিড ভিয়া এবং উরুগুয়ের দিয়েগো ফরলান। গোল্ডেন বুটের সেরা তিনে জায়গা না পেলেও উরুগুয়ের ঝাঁকড়া চুলের তারকা ডিয়েগো ফোরলান বাকি তিনজনকে পেছনে ফেলে ঠিকই গোল্ডেন বল জিতে নেন। ইকার ক্যাসিয়াস বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক নির্বাচিত হন। এই বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মত গোলকিপারকে লেভ ইয়াসিন এওয়ার্ডের পরিবর্তে গোল্ডেন গ্লাভ পুরস্কার দেওয়া হয়।

২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ
এক যুগের বিশ্বকাপ খরা ঘোচাতে নিজেদের মাঠে আবারো সেরা হিসেবে প্রমাণ করতে আশায় বুক বাঁধে ব্রাজিল সমর্থকেরা। অন্যদিকে মেসির কাঁধে ভর করে বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখে আর্জেন্টিনা ভক্তকুল। সেসময়ের সেনসেশন কলম্বিয়ান তারকা হামেস রদ্রিগেজ পুরো টুর্নামেন্টে বিষ্ময়কর ফুটবল খেলে ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট লাভ করে। অন্যদিকে বিশ্বের তাবত ফুটবল বিশ্লেষকরা মনে করছিল, প্রজন্মের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি তখনই সর্বকালের সেরা বিবেচিত হবেন যখন তার হাতে বিশ্বকাপের ট্রফি শোভা পাবে। বিশ্বকাপের এই আসরে তিনি এই ট্রফিতে চুমু প্রায় খেয়েই ফেলেছিলেন; কিন্তু তার দুঃস্বপ্নের নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন জার্মান সেনসেশন মারিও গোটশে। তার সেই শেষ মিনিটের গোলে আর্জেন্টিনা ভক্তদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আর সবশেষে রানার্সআপ দলের অধিনায়ক মেসিকে দেয়া হয় সেরা খেলোয়ারের পুরষ্কার।

এসএইচ/