পাকিস্তানে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশিত : ০১:০৪ পিএম, ২৬ মে ২০১৮ শনিবার
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত সেনাবাহিনী-ই নেপথ্যে থেকে সরকার চালাচ্ছে। এরইমধ্যে আগামী ৩১ মে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন আগামী ২৫ জুলাই দেশটির জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে। তবে সেনাবাহিনী ও নওয়াজ শরিফের মধ্যে ক্রমেই সৃষ্টি হতে থাকা দূরত্বের কারণে সাধারণ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ শঙ্কার কারণ, নওয়াজ শরিফের মতো তার দলকেও ক্ষমতার বাইরে রাখতে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত মুম্বাই হামলা নিয়ে নওয়াজ শরীফের করা মন্তব্য থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার দলের দূরত্ব আরও বাড়ে।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই আদালতের রায়ে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন নওয়াজ শরিফ। শরিফ তিনবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিনবারই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতা হারিয়েছেন। এরমধ্যে প্রথমবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে পদত্যাগ করেছেন, দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনী তাকে হটিয়েছে এবং তৃতীয়বারে আদালত। তবে শেষোক্ত বারেও আদালতের নেপথ্যে সেনাবাহিনীর হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তার।
এরইমধ্যে মুম্বাই হামলা নিয়ে নওয়াজ শরিফের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে।
সম্প্রতি নওয়াজ পাকিস্তানি গণমাধ্যম ডনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন, ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলায় পাকিস্তানের সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। নওয়াজ দুঃখ করে বলেন, দিন দিন পাকিস্তান নিজেদের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। তাছাড়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বেসামরিক জনগণের সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।
তার এসব মন্তব্যে বিতর্ক তৈরি হয়। ক্ষিপ্ত হয় সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও অনেক রাজনীতিক নওয়াজের উক্তির জন্য তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা ইমরান খান বলেছেন, নওয়াজ শরিফকে সংবিধানের ছয় অনুচ্ছেদের আওতায় এনে বিচার করা উচিত। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রদ্রোহিতার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
নতুন এ ইস্যু পাকিস্তানের গণতন্ত্রপন্থী বেসামরিক সরকার সমর্থক ও সামরিক বাহিনীর সম্পর্কে গভীর খাদ ও আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। তাই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন যত কাছে আসছে, ততই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, তার দল যাতে আসছে নির্বাচনে ক্ষমতায় না আসে তার সব ব্যবস্থা করবে সেনাবাহিনী।
আগামী ৩১ মে পাকিস্তানের বর্তমান সংসদের মেয়াদ ফুরাচ্ছে। আগামী ২৫ জুলাই সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘোষণা করা হয়েছে। এই সময়ে ক্ষমতাসীন দল ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনেক পাকিস্তানিরই শঙ্কা রয়েছে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির তৎকালীন প্রেসসচিব ফারহাতুল্লাহ বাবর মনে করেন, দেশের ভেতরে একটি `অগণতান্ত্রিক গোষ্ঠী` নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারা সফল হবে না।
যদিও পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বলছে, এসব শঙ্কা ভিত্তিহীন। কমিশনের মুখপাত্র আলতাফ আহমেদ বলেন, সবকিছু সঠিক পথেই এগোচ্ছে এবং নির্বাচন যথাসময়েই হবে।
ক্ষমতায় থাকা নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান রাজা জাফর উল হক বলেছেন, নির্বাচন বিলম্বিত হবে না। বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফের মুখপাত্র চৌধুরী ফাওয়াত হুসেইনও একই কথা বলেছেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ তাহির মেহেদী বলেন, পাকিস্তান কোনোভাবেই নির্বাচন বিলম্বিত করতে পারবে না, কেননা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
মোদ্দাকথা, দক্ষিণ এশিয়ার ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানে গণতন্ত্র এখনও ভংগুর পথেই হাঁটছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর, দেশটির গণতান্ত্রিকতার ইতিহাসে কয়েক দশক ধরে সামরিক শাসনের নজির রয়েছে। কিছুদিন পরপরই সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানে ক্ষমতাসীন ও নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাচ্যুত হচ্ছে।
পরিবারের সদস্যরা দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়ায় পদত্যাগ করতে হয়েছে নওয়াজকে। যদিও অনেকেই মনে করেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সেনাবাহিনীর বাইরে জনগণের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টার কারণেই তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানো ছাড়াও নওয়াজ শরিফের নিজের দলের নেতৃত্ব হারাতে হয়েছিল। পাশাপাশি সব সময়ের জন্য সব ধরনের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার হারান তিনি।
পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে নওয়াজ শরিফকে এভাবে একেবারে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াকে অনেক বিশ্নেষক দেখছেন ভিন্ন দৃষ্টিতে। তারা বলছেন, কোনো ধরনের অভ্যুত্থান ছাড়াই ক্ষমতা চর্চার জন্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ছায়ায় থেকে দেশ শাসনে তারা দক্ষ হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যতে সেটি ধরে রাখতেও পিছপা হবে না তারা।
সূত্র : ডয়েচে ভেলে।
/ এআর /