বৈষম্যের দোহাই দিয়ে কোটা আন্দোলন ন্যায়বিচার পরিপন্থী:অহিদুজ্জামান
প্রকাশিত : ০৬:৪৬ পিএম, ২৯ মে ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৭:৪২ পিএম, ৪ জুন ২০১৮ সোমবার
বিসিএসসহ সব ধরণের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের একপর্যায়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে কোটা পদ্ধতি তুলে দেওয়ার কথা বলেছেন। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়ে আন্দোলন স্থগিত করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মাস পেরোলেও কোটার সংস্কার বা বাতিলের বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। ফলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। আশা-নিরাশার দোলাচলে কাটছে চাকরি প্রত্যাশী লাখো তরুণের সময়।
এ পরিস্থিতিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা, চাকরিতের প্রবেশের বয়সসীমা, গ্রাজুয়েশনের পরও চাকরির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা, বেকারত্ব, কর্মসংস্থান, পাবলিক ও চাকরির পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম অহিদুজ্জামানের। কোটা পদ্ধতি ছাড়াও তাঁর কথায় উঠে এসেছে প্রশ্নফাঁস, পরীক্ষা পদ্ধতি, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা, কোচিং বাণিজ্য, বেকারত্ব, কর্মসংস্থানসহ নানা বিষয়ে।
দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি নিয়ে আপনার মত কি?
অহিদুজ্জামান: কোটা সংস্কার বা যেকোনো সংস্কার সময়ের ব্যবধানে হতে পারে। কোটা করা হয়েছিল সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এটা করা হয়েছিল আমাদের বৈষম্য নিরসনের জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নামে যে বিষয়টা বলা হচ্ছে যে, বৈষম্য কমানোর জন্য কোটা বাতিল করতে হবে, এখানে একটা বিষয়ে ভুলবোঝাবুঝি হয়েছে। একটা আন্দোলনে তো নানা ধরণের লোক আসে। আমার মনে এখানে অনেকেই এসেছে স্বার্থ হাসিলের জন্য।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা পদ্ধতি সংস্কারে জোর দাবি উঠেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ নিয়ে সংসদে কথা বলেছেন। কোটা সংস্কারের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
অহিদুজ্জামান: মনে রাখতে হবে আমাদের দেশটা হলো মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হওয়া দেশ। ২৩ লাখ মানুষ, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ, আপামর জনতা জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বলা হয়েছে মানুষের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। বৈষম্যের বিষয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এ শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৫ এ মৌলিক চাহিদার কথা বলা হয়েছে। আর অনুচ্ছেদ ১৯ এ গিয়ে নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৮ ও ২৯ এ নারী-পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। চাকরি থেকে শুরু করে যেকোন প্রতিষ্ঠানে সবার প্রবেশাধিকারের কথা বলা হয়েছে। এখানে আবার বলা হয়েছে নারী ও শিশুদের এগিয়ে আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যাবে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আনার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা করা যাবে। যেটি সমতার দিকটা ব্যাহত করবে না। সেই সমতার দিকটা নিশ্চিত করতেই কিন্তু কোটার বিষয়টা এসেছে।
কিন্তু যে সমতা নিশ্চিতের জন্য কোটা চালু করা হলো, সে সমতা কি নিশ্চিত হয়েছে? আমাদের মোট চাকরিজীবির মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ নারী আছে। তাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, সেবিকা এসব ক্ষেত্রে। আমরা কয়জন সচিবকে নারী হিসেবে দেখেছি? সেখানে হয়তো হাতে গোনা ৪ থেকে ৫ জন সচিব নারী আছে। এদের মধ্যে কেউ হয়তো মেধায় আসছে। কেউ নারী কোটায় আসছে। এখন তারা কি খারাপ করছে? তারা কি মেধাবী না? তারা কি অযোগ্য? কোনভাবে না। কেউ কোটায় চাকরি নিতে হলে, তাকেও তো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মেধার পরিচয় দিতে হচ্ছে। অথচ আমাদের জনশক্তির ৫১ ভাগ নারী। আর তাদের জন্য কোটা আছে মাত্র ১০ ভাগ। সচিবালয় ছাড়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দেখেন নারী সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু নারী তো দরকার হয়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর অনেকটিতেও নারীর কোটা রয়েছে। পিছিয়ে পড়া নানা জনগোষ্ঠীর কোটা আছে। আর আমাদের এটা আছে সাংবিধানিক ও বাধ্যতামূলকভাবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সবার দেশ। এটি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী দেশ। আপামর জনসাধারণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বলেই তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা বরাদ্দ করা হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নীতি হলো সামাজিক ন্যায়বিচার। ভারতে এখনও ট্রেন ও বিমানে ফাস্ট ক্লাস টিকেট দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের। চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে। সেদেশের হাসপাতালগুলোয় একটা বেড থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। বাংলাদেশে এখনও সেসব হয়নি। এটা করা উচিত।
এরপর আসেন জেলা কোটা। তারা বলে ৫৬ শতাংশ কোটার দখলে। আমি জানি না তারা কোথা থেকে এটা শিখছে। আমি মনে করি ১০০ ভাগ মানুষের জন্যই ৫৬ শতাংশ কোটা। ১০০ ভাগ মানুষের সমতা নিশ্চিতের জন্যই কোটা। শতভাগ মানুষের ন্যায় বিচার নিশ্চিতের জন্য এ কোটা। সুতরাং যারা কোটার মাধ্যমে বৈষম্য হচ্ছে বলছে, তাদের এটা একটা ভুল ধারণা। কোটা সংস্কারকে যেভাবে সামনে আনা হয়েছে, আমি মনে করি সেটা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। এটার সঙ্গে ন্যায়বিচার যায় না।
যেমন জেলা কোটা আমাদের প্রত্যেকের কোনো না কোনো জেলায় বাড়ি আছে। জেলা কোটা আনা হয়েছে শতভাগ মানুষের সমতা নিশ্চিতের জন্য। ধরেন লেখা-পড়ায় বরিশাল জেলা এগিয়ে আছে। এখন আমরা যদি শতভাগ মেধায় যাই, তবে তারাই তো বেশি পাবে। অথবা রাজনৈতিকভাবে কোনো এলাকা, যেমন ফরিদপুর বা গোপালগঞ্জ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি। তারা তো একটা সুযোগ পেতে পারে। সেখানে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য বা আমলারা যদি বেশি থাকেন। সবাই তো নিজের এলাকার উন্নয়ন চান। এজন্য দেশের সামগ্রিক সমতাভিত্তিক উন্নয়নের স্বার্থেই এ কোটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেকোনো বরাদ্দের ক্ষেত্রেও কিন্তু পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি সামনে আনা ন্যায় বিচার।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কথা বলেছেন। সে কারণে ছাত্ররা আন্দোলন স্থগিত রেখেছিল। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলেও এখনও সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। বিষয়টির সমাধান কোন দিকে যাচ্ছে?
অহিদুজ্জামান: প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা তিনি হয়তো করবেন। সে প্রক্রিয়া তো শুরু হয়ে গেছে। একেবারে এখনই করতে হবে এমন ঠেকায় তো কেউ পড়ে নাই। এটা তো হুট করে করা যায়ও না। এটার তো একটি আইনী ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়া আছে। আর বিলম্বের কথা কোন ছাত্র বলতে পারে না। এটা বলছে গুটিকয়েক লোক, যাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। এটার জন্য তো কমিটি লাগবে। কমিটি এরই মধ্যে হয়েছে। তো এটার জন্য এতো অস্থির হওয়ার কি আছে? এখনও তো নতুন কোন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসেনি।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটা সংস্কারে কোন প্রশাসনিক জটিলতা দেখছেন কি না?
অহিদুজ্জামান: তবে এ আন্দোলন বিশেষ নিয়োগ বন্ধের জন্য যৌক্তিক হতে পারে। তরুণদের মধ্যে এই জায়গাটিতে ক্ষোভ এসেছে বলে আমার পর্যবেক্ষণ বলে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায় আছে যদি নিয়োগে খালি থাকে তবে খালি রাখতে হবে। এখন কোর্টের যেখানে আদেশ আছে সেখানে সরকার কি করবে? এখন ছাত্ররা কোর্টের বিষয় কোর্টে গিয়ে আপিল করতে পারতো।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটার এ আন্দোলনকে অনেকে বিশেষ মহলের ইন্ধন বলছেন। আবার অনেকে এটাকে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন হিসেবে দেখছেন। বিষয়টি আপনার কাছে কি মনে হয়?
অহিদুজ্জামান: এবারের আন্দোলনে বাম-ডান নানা রঙের লোক আছে। কিছু লোক আছে যারা হয়তো যৌক্তিক জায়গা থেকেই এসেছে। মানুষ আমরা তো প্রায়ই সবাই আত্মকেন্দ্রীক। সাধারণরা মনে করে নিয়োগে ৯৯টা হয়েছে আমার হয়নি। যদি ১০০ হতো তবে আমার হতো। এখানে কতজন মানুষ আন্দোলন করেছে? কয়টা মেয়ে আন্দোলনে ছিল? যারা আন্দোলন করেছে তাদের মধ্যে কয়টা মেয়ে বিসিএস দেবে? এরা সবাই মূলত মিসগাইডেড।এভাবে যদি বলা হয় যে, তিনভাগ মানুষের জন্য ৫৬ ভাগ কোটা। আমাদের যারা জ্ঞানপাপী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, টকশোয়ার তারাই এসব কথা বলছেন। কোন হিসেবে তারা এটা বলছে আমার বুঝে আসে না।
এ সংস্কারের জন্য আন্দোলন যেভাবে রূপ লাভ করেছিল, সেটা খুবই অযৌক্তিক। এর মধ্যে নানা উপসর্গ ছিল। সেটা এখন স্পষ্ট। অনেকে আবার রাজনীতি ছাড়াও আসছে। তারা না বুঝে আসছে। তাদেরকে এর জন্য দুর্ভোগও পোহাতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: কোটার আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা হয়েছে। একজন উপাচার্য হিসেবে বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অহিদুজ্জামান: এটা আন্দোলনের নামে বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এটার রাজনৈতিক একটা ব্যাপার আছে। এটা যেন একটা কালচারে পরিণত হয়েছে। আমরা সংসদে, টকশোতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন হিংসাত্মক বিষয় দেখতে পাই। আমাদের এ ধরণের কালচার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কোটা বিধি সংস্কারের দাবি আছে। দাবি হতে পারে। কারণ না কাঁদলে মাও দুধ দেয় না। তার জন্য দাবিগুলো সেমিনারে তুলে ধরা যায়, স্মারকলিপি দেওয়া যায়, ক্লাস বর্জন করা যায়, প্রতীকি অনশন করা যায়, এমনকি রাস্তার উপর বসে পড়াও ঠিক আছে। কিন্তু এ দাবিতে আন্দোলনের নামে দাঙ্গাটা কোন পর্যায়ে যেতে পারে। এ আন্দোলন যৌক্তিকতার সঙ্গে এ সহিংসতার কোনো সম্পর্ক নেই। এ সহিংসতা কোনো দেশেই কাম্য নয়। আমি মনে করি এগুলো ভালোভাবে তদন্ত করে দেখা উচিত। কারা করেছে তাদের খুঁজে বের করা উচিত।এটা ছাত্রদের কাজ না। এর আগে ওই উপাচার্যের অফিসেও হামলা হয়েছিল।হামলাকারীরা তথাকথিত বাম-ডান নানা রঙের ছাত্র নেতা।
একুশে টিভি অনলাইন : আমাদের সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ওহিদুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ।
/ এআর /