ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আমার প্রথম প্রেম, আমার সাংবাদিকতা

হাসান আকবর

প্রকাশিত : ০৯:১৬ পিএম, ৪ জুন ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ১০:০৬ পিএম, ৬ জুন ২০১৮ বুধবার

হাসান আকবর

হাসান আকবর

আশির দশকের শেষদিকে বন্ধু হাসান খায়রুল ইসলামের সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিলাম সাংবাদিক আব্দুল আজীজ মাহফুজের সঙ্গে। তিনি সীতাকুণ্ডের মাঠ পর্যায়ের প্রথম সাংবাদিক। সম্পাদক। সাপ্তাহিক বারুদ এবং সাপ্তাহিক গিরি-সৈকতের জন্ম মাহফুজ ভাইয়ের হাতে। মাহফুজ ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম পত্রিকায় গল্প ছাপাতে। সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এই আমি কেমন করে যেন সাংবাদিক হয়ে গেলাম। গুরু সেই মাহফুজ ভাই। পত্রিকা প্রকাশনা থেকে পত্রিকা বিক্রি, ফটোগ্রাফার থেকে রিপোর্টার, রিপোর্ট এডিট থেকে প্রুফ কাটা, হকারী থেকে রিপোর্টারগিরী সবই চলছিল সমানতালে। চুল আছড়ানোর কথা মনে থাকতো না, শার্ট ইস্ত্রিরতো প্রশ্নই উঠে না। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে, রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে, কখনো বাসে কখনো ট্রাকে কখনো কাদা পানি মাড়িয়ে পথ চলেছি সীতাকুণ্ডের আনাচে কানাচে। দূরন্ত যৌবনের শুরুতে প্রেমে পড়েছিলাম সাংবদিকতার। দিন যেতো। রাত হতো। কিন্তু থামতো না আমার ছুটে চলা।

আমার প্রথম প্রেম সাংবাদিকতা। সেই প্রেম নিয়ে কানাঘুষার কমতি ছিল না। আড়ালে আবড়ালে পাগল ডাকা হতো। বলা হতো পাগলামি করে জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে ছেলেটা। আত্মীয় স্বজন আফসোস করতেন। শুনতাম। নিজেও বুঝতাম। টের পেতাম পাগলামীর মাত্রা। হামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে। রক্তাক্ত করা হয়েছে। লাশ মনে করে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছিল। হাত কেটে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমার প্রেম উবে যায়নি। প্রথম প্রেমের নেশাগ্রস্ত এই আমি সাংবাদিকতা ছাড়তে পারিনি। কেবলই ছুটতাম। ছুটতাম। ছুটতাম কেবলই।

ছুটে চলার এই ধারায় একদিন হঠাৎ পরিচয় হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সাবেক চিফ রিপোর্টার, চট্টগ্রামের কৃতি সাংবাদিক মরহুম ওবায়দুল হক সাহেবের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি আমার প্রেমটা টের পান। কী মনে করে তিনি আমাকে দৈনিক আজাদীর সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্ত হয়েছিলাম দৈনিক আজাদীর সঙ্গে। অতপর, দীর্ঘ পথ চলায় দৈনিক আজাদীর সাবেক সম্পাদক মরহুম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেকের প্রশ্রয় এবং সহায়তায় একের পর এক ধাপ পেরিয়েছি। গত তের বছরেরও বেশি দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

সীতাকুণ্ডে আমি যখন পাগলামী শুরু করেছিলাম তখন আশে পাশে কেউ ছিলেন না। পরবর্তীতে অনেকেই সাথী হয়েছেন। অনেকেই আজ ঢাকা এবং চট্টগ্রামের তারকা সাংবাদিক। বন্ধু মামুন আবদুল্লাহ, বন্ধু সাইফ ইসলাম দিলাল, মোহাম্মদ ইউসুফ, বন্ধু আবুল হাসনাত, বন্ধু বোরহান, ছোট ভাই মিল্টন রহমান, ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম শিল্পীসহ অনেকেই রয়েছে ভালো অবস্থানে। দেশের সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করেছে সীতাকুণ্ডের এসব কৃতি সাংবাদিক।

দৈনিক আজাদীর সঙ্গে জড়িত হওয়ার পর আমি কোনদিন আর কোন পত্রিকায় কাজ করার চেষ্টা করিনি। প্রায় বিশ বছর আগে বেতন কম বলে সাংবাদিকতা ছেড়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পদে যোগ দেয়া চূড়ান্ত করেছিলাম। এই সময় পাশে দাঁড়ান দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক। অতপর রক্ষা পেয়ে যায় আমার প্রেম, আমার সাংবাদিকতা।

দৈনিক আজাদীতে কাজ করছি সেই দূরন্ত যৌবনের শুরু থেকে। লিখেছি অনেক। অজস্র প্রতিবেদন তৈরি করেছি চট্টগ্রামের নানা বিষয়ে। কিন্তু কোনদিন কোন পুরস্কার পাইনি। পুরস্কারের জন্য রিপোর্ট জমা দিতে হয়। আমি কোনদিনই আমার কোন রিপোর্ট কোথাও জমা দিইনি। নিজের রিপোর্ট বা প্রতিবেদন পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য বলেও আমি মনে করিনি। নিজের মতো করে নিজে থেকেছি। নিজের কাজ নিজে করেছি। নিজের বিবেকের সাথে কোনদিন আপোষ করে কোন কিছু করিনি। সাংবাদিকতাকে কলংকিত করিনি। প্রথম প্রেমের প্রতি মমত্ব এবং যত্ন কোন কিছুতেই কোন ঘাটতি রাখিনি।

সীতাকুণ্ড থেকে গত বছরও একটি প্রসিদ্ধ সংগঠন আমাকে পদক দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। নিজেকে কোনভাবেই যোগ্য মনে করিনি বিধায় আমি বিনীতভাবে না করেছিলাম। চাটগাঁর বাণীর প্রধান সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফ যখন বললেন যে, একটি সার্চ কমিটি সাংবাদিকতায় আমার নাম প্রস্তাব করেছে। তখন আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে ছিলাম। সীতাকুণ্ডের এত এত বিখ্যাত মানুষদের কাতারে নিজের নাম আছে জেনে নিজেই বিস্মিত হয়েছিলাম।  সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামাণ্য অবদান রাখা ২৬ জন মানুষের সঙ্গে আমিও একজন জেনে পুরো শরীর মন শিরশির করে উঠেছিল।

চাটগাঁর বাণী পত্রিকা হিসেবে হয়তো বড় নয়, পদক হিসেবেও হয়তো তেমন কুলীন নয়. তবে সীতাকুণ্ডের কৃতি পুরুষ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশের লায়নিজমের জনক মরহুম এম আর সিদ্দীকি, সাবেক মন্ত্রী ও ডেপুটি স্পিকার মরহুম ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দীকি, খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ এবিএম আবুল কাসেম, মহান মুক্তযুদ্ধের সংগঠক এম এ মামুন, প্রখ্যাত সমাজসেবক সুরুজ মিয়া, প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, আমার শিক্ষাগুরু মরহুম নুরুল আলম, ডা. এখলাস উদ্দীন, শিক্ষার জীবন্ত কিংবদন্তী নজির আহমদ, খ্যাতিমান ব্যাংকার ফারুক মঈনুদ্দীন, তাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতি মানুষগুলোর কাতারে নিজেকে আবিষ্কার করে মনে হলো আমার প্রথম প্রেম আমার সাথে প্রতারণা করেনি। অকাতরে দিয়েছে দুহাত ভরে।

সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণীর ১৭তম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আজ আগ্রাবাদের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে আলোকিত এক অনুষ্ঠানে এই সম্মাননা প্রদান করা হয়।

লেখক পরিচিতি: হাসান আকবর, চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

এসএইচ/