ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

দালালের খপ্পরে পঙ্গু হাসপাতাল

অালী অাদনান

প্রকাশিত : ০৮:৫৮ পিএম, ৯ জুন ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১০:১৫ এএম, ১০ জুন ২০১৮ রবিবার

মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার। সেই অধিকারের কথা বিবেচনায় রেখেই রাষ্ট্র ধনী-গরিব সব রোগীর চিকিৎসার্থে প্রতিষ্ঠা করে সরকারি হাসপাতাল। রাজধানী ঢাকায় তেমনি অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি হলো জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূনর্বাসন প্রতিষ্ঠান। তবে অনেকের কাছে এটি পঙ্গু হাসপাতাল নামে পরিচিত।

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। মূলত হাড়ভাঙ্গা, হাড়জোড়া দেওয়া, হাতে টিউমার, দুর্ঘটনায় অাঘাতপ্রাপ্ত, পঙ্গু-বিকলাঙ্গ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার কথা মাথায় রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল। তবে অন্য অনেক সরকারি হাসপাতালের মতো জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। বিশেষ করে দালালদের দৌরাত্মে সাধারণ রোগীরা একদিকে যেমন প্রতারিত হয় অন্যদিকে বঞ্চিত হয় চিকিৎসা সেবা থেকে।

হাসপাতালটির বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে ও রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালে নিয়মিত সক্রিয় থাকে কয়েকটি দালাল চক্র। এছাড়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও অনেক সময় সক্রিয় থাকে দালালীতে। বর্হিবিভাগের কাজ মূল ভবন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের ভবনে স্থানান্তরের পর সেই দালাল চক্রটি অারও সক্রিয় হয়ে উঠে।

প্যাথলজি ও এক্সরে বিভাগেও রোগীদেরকে সব সময় দালালদের কাছে জিম্মি থাকতে হয়। এ ব্যাপারে কথা হয় বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নিতে অাসা ফারজানা অাক্তারের সঙ্গে। ফারজানা অাক্তারের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায়। তার ছেলে বশির অাহমদ সড়ক দুর্ঘটনায় হাত ভেঙ্গে ফেলেন। তাই এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ফারজানা অাক্তার এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, সরকারি হাসপাতালে নিয়ম অনুযায়ী এক্সরে ফি ৫৫ টাকা। কিন্তু সিরিয়াল এগিয়ে দিতে রোগীপ্রতি খরচ হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা।

একই অভিযোগ করলেন কুমিল্লার চান্দিনা থেকে অাসা যুবক ও মোহাম্মদপুর মাদ্রাসার ছাত্র অাবুল কাশেম। এ প্রতিবেদকের কাছে তিনি অভিযোগ করে বলেন, ড্রেসিং, এমঅারআই, সিটিস্ক্যান, অালট্রাসনোগ্রাফী সবকিছু পরীক্ষার সিরিয়াল নেওয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয় রোগীদের।  টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সিরিয়াল পিছিয়ে দেওয়া হয়। অার তাতে রোগীর অবস্থা সংকট থেতে সংকটাপন্ন হয়।

হাসপাতালটির কেবিন ব্লকে ১১৫ নং কেবিনে অালাপ হলো সুলতানা করিম নামে একজন রোগীর সঙ্গে। তিনি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে পড়ছেন। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে পায়ের হাড় ভেঙে যায় সুলতানা করিমের। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে অালাপকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, কেবিন খালী থাকলেও কেবিন পাওয়া যায় না। উচ্চপদস্থ কোন কর্মকর্তা বা বড় কোন রাজনীতিবিদের ফোন ছাড়া সহজে কেবিন দেওয়া হয় না।

একই অভিযোগ করলেন গোপালগঞ্জ থেকে বোনকে নিয়ে হাসপাতালে অাসা যুবক অাবুল কালাম অাজাদ। এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, এখানে ডাক্তারদের অাচরণ সহনশীল। তবে অায়া বুয়াদের অাচরণ জঘন্য। পাশাপাশি দালালদের কাছে সব সময় জিম্মি থাকতে হয়। কেমন জিম্মি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ড্রেসিং, এমঅারঅাই, সিটিস্ক্যান, অালট্রাসনোগ্রাফী সবজায়গাতে দালালদের শরনাপন্ন না হলে সেবা পাওয়া যায় না। প্যাথলজি বিভাগে রোগীদের ওষুদের রশীদ দেওয়া হয় না। মিথ্যা কথা বলে অাদায় করা হয় বেশি অর্থ।

জরুরি বিভাগ, অপারেশন থিয়েটার, এক্সরে বিভাগ, রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগেও চলে দালালদের দৌরাত্ম্য। তবে এসব দালালরা বেশির ভাগই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।

 জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে অারেকটি দালাল চক্র সক্রিয়। তবে তারা হাসাপাতালে ওয়ার্ডে বা কেবিনে কাজ করে না। তাদের ডিউটি মূল ফটক ও অাশে পাশের এলাকায়। এরা মূলত গ্রাম থেকে অাসা সহজ সরল রোগীদের বিভ্রান্ত করে হাসপাতালে ভর্তি হতে না দিয়ে শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর এলাকার বিভিন্ন ক্লিনিকে নিয়ে যায়।

এক দালালের সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানায়, সরকারি হাসপাতালের রোগী কোন ক্লিনিকে নিয়ে গেলেই রোগী প্রতি পাওয়া যায় দুই হাজার টাকা কমিশন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই দালাল স্বীকার করেন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ জন দালাল উঁৎ পেতে থাকে। অাগে এই সংখ্যা অারও বেশি ছিল। গত বছর পুলিশ ও র‌্যাবের চালানো কয়েকটি অভিযানের পর দালালদের তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেলেও সম্প্রতি অাবার তাদের দৌরাত্ম শুরু হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক দালাল স্বীকার করলেন তিনি শ্যামলীর একটি কৃত্রিম পায়ের দোকানের সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করেন। সরকারি হাসপাতালে বেশি টাকা খরচ হবে- এমন অভিযোগে ফুঁসলিয়ে রোগীদের ওই দোকানে নিয়ে কৃত্রিম পা বিক্রি করতে পারলেই জোটে মোটা অংকের কমিশন। অথচ জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পূনর্বাসন কেন্দ্রে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে রয়েছে পা লাগানোর সুযোগ।

 এব্যাপারে হাসাপাতালের কোন কর্মকর্তা কথা বলতে রাজী হননি। বরং তেমনি একজন কর্মকর্তা পরামর্শ দেন এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক ইকবাল কাভীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু পরিচালক ইকবাল কাভীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

 

এসএইচ/