ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

পিএসসি-জেএসসি ও এমসিকিউ বাদ দিতে হবে : মনজুরুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৭:২৬ পিএম, ১১ জুন ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০১:১৬ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

কথা‌সাহিত্যিক, শিক্ষা‌বিদ  ও রাজনৈ‌তিক বি‌শ্লেষক হি‌সে‌ব সুপ‌রি‌চি‌তি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। প্রতিথযশা এ শিক্ষাবিদ শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে আসছেন। যেগুলো জাতির জন্য দিশা হিসেবে বিবেচিত।

বর্তমান শিক্ষা ও প‌রীক্ষা পদ্ধ‌তি এবং কোটা পদ্ধতির সংস্কার, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাসহ সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জানতে সম্প্রতি একুশে টিভি অনলাইন মুখোমুখি হয় এ শিক্ষাবিদের। তি‌নি মনে করেন বাংলাদেশের সমৃদ্ধিকে এগিয়ে নিতে হলে শিক্ষার গুণগত মানে পরিবর্তন আনতে হবে। সনদমুখী শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে উৎপাদনমুখী শিক্ষায় জোর দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাথা থেকে পরীক্ষার বোঝা কমাতে হবে।  সেজন্য পিএসসি-জেএসসি পরীক্ষার পাশাপাশি এমসিকিউ পরীক্ষাও তুলে দিতে হবে।

সাক্ষাৎকার‌ নি‌য়ে‌ছেন মোহাম্মদ রু‌বেল। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-

একু‌শে টি‌ভি অনলাইন : বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কি ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার বলে আপনি মনে করেন?‌

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম : বি‌দে‌শের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমা‌দের শ্রেণীক‌ক্ষে শুধু মুখস্থ‌বিদ্যা চর্চা হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থা দি‌য়ে বে‌শিদূর এগোনো যাবে না। তাই বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা হওয়া উচিত। যেখা‌নে জ্ঞান নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীকে পৃথিবীর জন্য তৈরি করা হবে। ‌সেখা‌নে একজন শিক্ষার্থী‌কে বিষদ ‌বিষয়ে গভীর জ্ঞান দেওয়া হ‌বে। তার অধিতব্য বিষ‌য়ের পাশাপা‌শি প্রকৃ‌তি, জীবন, সমাজ ইত্যা‌দি বিষ‌য়েও জানা‌তে হ‌বে। এবং তা‌কে প্রকা‌শের এবং যোগা‌যো‌গের জন্য যা যা দক্ষতার দরকার সেই ধর‌নের সব শিক্ষা দি‌তে হ‌বে। আমাদের ভাষা দক্ষতা শূ‌ণ্যের কোঠায়। নি‌জের মাতৃভাষায় দক্ষতা নেই আর অন্য ভাষার দক্ষতা তো বহু দূরের কথা।

বাংলা‌দেশ‌কে উন্নয়‌নের মহাসড়কে টিকে থাকতে হলে ভাষার মাধ্য‌মে বি‌শ্বের সঙ্গে যোগা‌যোগ তৈরি করতে হবে। আমা‌দের ‌সেই দক্ষতা কোথায়? তাই আমা‌দের ‌তো ভাষার দক্ষতা, বিজ্ঞানের দক্ষতা, গ‌ণি‌তের দক্ষতা, প্রযু‌ক্তির দক্ষতা নি‌তে হ‌বে। কিন্তু বিশাল সংখ্যক স্কুল,ক‌লেজ এবং বিশ্ব‌বিদ্যালয় ‌এই বিষয় গ‌ু‌লো‌ এখ‌নো বাইরে র‌য়ে‌ গে‌ছে। একজন শিক্ষার্থী এম এ পাশ ক‌রে বের হ‌চ্ছে কিন্তু এর বাই‌রে অন্যকোনো বিষ‌য়ে জ্ঞান লাভ কর‌ছে না।‌ কিন্তু বি‌দে‌শে তা হয় না। তাই বলব, বাংলা‌দেশ‌কে উন্নয়নশীল রা‌ষ্ট্রে প‌রিণত কর‌তে হ‌লে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা চালু কর‌তে হ‌বে। যেখা‌নে একজন শিক্ষার্থী কেবল এমএ পাশের সনদ নয়, জ্ঞান নির্ভর শিক্ষায় দক্ষ হ‌য়ে পৃথিবীর জন্য তৈরি হবে। এ ‌বিষয়টা আমা‌দের শিক্ষা ব্যবস্থায় নি‌শ্চিত কর‌তে হ‌বে।

একু‌শে টি‌ভি অনলাইন: শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য কমা‌তে শিক্ষা খা‌তে কী পরিমান বা‌জে‌ট দেওয়া উচিত?

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম: শিক্ষা‌তে অবশ্যই বা‌জেট বাড়া‌তে হ‌বে। বিশ্বব্যা‌পী স্বীকৃত শিক্ষা খা‌তে বা‌জেট বরাদ্দ হ‌চ্ছে জি‌ডি‌পির ৬ শতাংশ। যেসব শিক্ষায় এ প‌রিমাণ বা তার চে‌য়ে বে‌শি বাজিটে দি‌য়ে‌ছে সে দেশগু‌লি তার সুফল ভোগ করেছে। যেমন- ভি‌য়েতনাম, ম‌লি‌য়ে‌শিয়া। কিউবা পর্যন্ত শিক্ষাখা‌তে জি‌ডি‌পির ৯ শতাংশ বাজেট দি‌চ্ছে। আর বাংলা‌দেশ সেখা‌নে মাত্র ২ শতাং‌শের ম‌ধ্যে ঘুরপাক খা‌চ্ছে। যা ভারত, শ্রীলঙ্কা, পা‌কিস্তান, ‌নেপাল এমন‌কি ভূটান থে‌কেও কম। অথচ আমা‌দের দা‌বিটা ছিল বে‌শি। মোট বা‌জে‌টের ২৫ শতাংশ রাখার দা‌বি ছিল শিক্ষাখা‌তে। একটা সময় ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কন্তিু সেখান থে‌কেও না‌মি‌য়ে বর্তমানে ১২ শতাং‌শে আনা হ‌য়ে‌ছে। অর্থাৎ আমরা দুই দিক থে‌কেই কম দিচ্ছি। কিন্তু বাংলা‌দেশকে উন্নত রা‌ষ্ট্রে প‌রিণত কর‌তে হ‌লে, উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা নি‌শ্চিত কর‌তে হ‌বে। আর তা কর‌তে হ‌লে শিক্ষাখা‌তে বা‌জেট বাড়া‌তে হ‌বে।

একু‌শে টি‌ভি অনলাইন: বাংলা‌দে‌শে এখন কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বে‌শি। এ বিপুল পরিমাণ তরুণ জনশ‌ক্তি‌কে কিভা‌বে কা‌জে লাগা‌নো যে‌তে পা‌রে? এ‌ক্ষে‌ত্রে উৎপাদনমু‌খি শিক্ষা ব্যবস্থা কতটা জরুরি ব‌লে আপ‌নি ম‌নে ক‌রেন?

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম : হ্যাঁ অবশ্যই জরুরী। উৎপাদনমু‌খি শিক্ষা হ‌চ্ছে ‌যে শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর এমন উপাদান আছে, ‌যা দি‌য়ে শিক্ষা পূর্ণতা পাবে। যে শিক্ষা উৎপাদনের কা‌জে লাগ‌বে। অর্থাৎ উৎপাদ‌নের অ‌নেকগু‌লো অর্থ ‌আছে। প্রথমত, মানব সম্পদ উৎপাদন। মানব সম্পদ উন্নয়ন হ‌চ্ছে অর্থাৎ যে মানুষ‌টি শিখ‌ছে শিক্ষা থে‌কে মেধার উন্নয়ন, প্রকাশ এবং বিকা‌শের উন্নয়ন। এ বিষয়গু‌লোর পাশাপা‌শি আরও ক‌য়েকটা বিষয় জ‌ড়িত। যেমন- কেউ সা‌হিত্য পড়‌লে তা‌কে দর্শন পড়‌তে হ‌বে, জীবন যাত্রা সম্প‌র্কে জান‌তে হ‌বে, সমাজতত্ত্ব সম্প‌র্কেও জান‌তে হ‌বে। আবার পদার্থ বিজ্ঞান পড়‌ছেন তা‌কে রসায়নও জান‌তে হ‌বে, তাকে মাই‌ক্রো বায়ো‌লো‌জিও জান‌তে হ‌বে ইত্যা‌দি। এই বিষয়গু‌লি নি‌শ্চিত করার জন্য উৎপাদনমু‌খি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু কর‌তে হ‌বে।

একু‌শে ‌টি‌ভি অনলাইন: প্রশ্ন ফাঁ‌সের ঘটনা গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে-ই প্রশ্ন‌বিদ্ধ ক‌রে তো‌লে‌ছে। প্রশ্ন ফাঁ‌সের পেছ‌নে কারণ কি?

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম: প্রশ্নফাঁস তো এক‌টি অপ্রত্যা‌শিত ঘটনা। বুঝ‌তে হ‌বে যে‌খা‌নে এটি ঘট‌ছে সেখা‌নে অনেক দূর্বলতা আছে। সেখা‌নে পদ্ধ‌তিগত দূর্বলতা নি‌য়ে ব্য‌াক্তিগত দূর্বলতাও অর্ন্তভূক্ত।

একু‌শে টি‌ভি অনলাইন: বর্তমান বাস্তবতায় পরীক্ষা পদ্ধ‌তিতে প‌রিবর্তন আনাটা কতটা জরুরি?

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: শিক্ষাব্যস্থার পদ্ধ‌তিগত দূর্বলতার কার‌ণেই প্রশ্ন ফাঁ‌সের মত অপ্রত্যা‌শিত ঘটনা ঘ‌টে‌ছে। আর এ ঘটনায় বড় ভূ‌মিকা পালন করে‌ছে কো‌চিং বা‌ণিজ্য।। এ ঘটনায় পু‌রো শিক্ষাব্যবস্থা‌কে ধ্বং‌সের মুখ‌ে ঠে‌লে দি‌য়ে‌ছে। এ অবস্থা থে‌কে ভ‌বিষ্যৎ প্রজন্ম‌কে বাঁচা‌তে হ‌লে, আমি ম‌নে ক‌রি, শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার ও উৎপাদনমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা অপ‌রিহার্য। শুধু এম‌সি‌কিউ তু‌লে দি‌লে হ‌বে না। শিক্ষার্থী‌দের মাথার উপর থে‌কে পরীক্ষার বোঝা ক‌মি‌য়ে পিএস‌সি এবং জেএস‌সি পরীক্ষা তু‌লে দি‌তে হ‌বে। পাশাপা‌শি শ্রেণীভি‌ত্তিক মূল্যায়‌নের ব্যবস্থা চালু কর‌তে হ‌বে।‌ ‌বিশেষ ক‌রে সৃজনশীল পদ্ধ‌তি‌তে পাঠদা‌নে শিক্ষক‌দের প্র‌শিক্ষ‌ণের ব্যবস্থা কর‌তে হ‌বে। শিক্ষার্থী‌দের জন্য আনন্দময়ী পাঠদা‌নের ব্যবস্থা নিশ্চিত কর‌তে হ‌বে।

একু‌শে টি‌ভি অনলাইন: পাব‌লিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থী‌দের পা‌সের হার বাড়‌ছে। কিন্তু এই বৃ‌দ্ধির সা‌থে ‌সঙ্গে ‌‌কি শিক্ষার গুণগত মান বাড়‌ছে?

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম : শিক্ষার গুণগত মান বাড়‌ছে না তার কারণটা‌ হচ্ছে, মুখস্থ‌বিদ্যার মধ্য দি‌য়ে শিক্ষায় গু‌ণের প্রকাশ পায় না। যে মুখস্থ কর‌তে পারে তা তার সৃ‌তিশ‌ক্তির উপর নির্ভর ক‌রে। কিন্তু মূল শিক্ষা‌ হ‌চ্ছে সৃজনশীল। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী যা পড়‌ছে তা নি‌জের ভাষায় তা প্রকাশ কর‌তে পার‌ছে কিনা? তার পাশাপা‌শি অন্যান্য বিষয়গু‌লো সে পড়‌তে পার‌ছে কিনা? সমস্ত পৃ‌থিবী‌কে তার জানার আগ্রহ তৈরি হ‌চ্ছে কি না? এবং সে যে বিষয় গু‌লোর উপর পড়া‌শোনা ক‌রে‌ছে তার উপর সম্পূর্ণ অধীকার প্র‌তি‌ষ্ঠিত কর‌তে পার‌ছে কিনা?এই বিষয়গু‌লো হ‌চ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফলের ভি‌ত্তি‌তে শিক্ষার্থী‌দের হা‌তে জি‌পিএ ফাইভ আর ইত্যা‌দির যে সনদগু‌লো তু‌লে দেওয়া হ‌চ্ছে। তা‌তে ‌যে খুব মেধার মূল্যায়ন হ‌চ্ছে তা বলা যা‌বে না । ফ‌লে আ‌মি মনে ক‌রি পরীক্ষার পদ্ধ‌তির প‌রিবর্তন দরকার, বিদ্যাল‌য়ের শিক্ষাদান এবং শিক্ষণ পদ্ধ‌তিরও প‌রিবর্তন দরকার। শিক্ষার মান এবং গু‌ণের বিকাশ যা‌তে প্রকা‌শিত হয় সে রকম শিক্ষাব্যবস্থা  প্র‌য়োগ করা উচিত। অর্থাৎ সেখা‌নে সৃজনশীল চিন্তা ধারার হ‌তে হ‌বে। অর্থাৎ সেখা‌নে একজন শিক্ষার্থী কি বুঝ‌লেন, তা যেন নিজের ভাষায় প্রকাশ কর‌তে পা‌রে। সে বিষয়‌টি রাখ‌তে হ‌বে। যা‌তে সেই রকম হয় নি‌শ্চিত কর‌তে পা‌রে।  

প্রথম পর্ব

কোটা বাতিল নয়, সংস্কারেই সমাধান : মনজুরুল ইসলাম

/ এআর /