ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

রাজনীতি নয়, খেলা জিতে যায়

প্রকাশিত : ০৩:১৯ পিএম, ১৩ জুন ২০১৮ বুধবার

খেলার সঙ্গে  রাজনীতি অনেকেই ফারাকে রাখতে চান৷ বলতে চান খেলা হচ্ছে, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই৷ আসলে মোটেও তা নয়! খেলার মাঠে রাজনীতি ঢুকেই পড়ে৷ বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাস ব্যতিক্রম হবে এমন ভাবার কারণ নেই৷ এবারের বিশ্বকাপ শুরুর আগেই তো পরিস্থিতি যথেষ্ট তেতে উঠেছিল৷

চলতি বছরের ৪ মার্চ সাবেক রুশ গোয়েন্দা সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার মেয়েকে সোভিয়েত আমলের নার্ভ এজেন্ট দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইংল্যান্ড থেকে ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে দেশটির সরকার৷ এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া থেকেও ২৩ জন ব্রিটিশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়৷

ঘটনা গড়াতে শুরু করলে ইংল্যান্ডের সরকার দলের মন্ত্রী এবং রাজপরিবার থেকে ঘোষণা আসে, তারা কেউ রাশিয়া বিশ্বকাপের খেলা দেখতে যাবেন না৷

ইংল্যান্ড দলেরও বিশ্বকাপ বয়কটের শঙ্কা দেখা দিয়েছিল৷ অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোও বিশ্বকাপ বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা চিন্তা করছিল৷ তবে শেষ পর্যন্ত সব দলই বিশ্বকাপে আসছে৷ যেমনটা এসেছিল গত বিশ্বকাপের আগ দিয়েও৷

২০১৪ সালের ওই বিশ্বকাপের আগ দিয়ে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া নিয়ে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা নব্বই-পূর্ববর্তী স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল৷

বিশ্বকাপ ফুটবল সামনে রেখে তখন আমেরিকার দু`জন সিনেটর এবং রাশিয়ার দুই সিনেটর একে অপরের দেশকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কারের জন্য ফিফার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছিলেন৷ ফিফা অবশ্য খেলার সঙ্গে রাজনীতিকে যুক্ত না করার নীতি অনুযায়ী আমেরিকা বা রাশিয়া কোনও পক্ষের চিঠিকেই পাত্তা দেয়নি৷

সেই সময় থেকেই আমেরিকা ও ইংল্যান্ড রাশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ বন্ধ করতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছিল রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা এ নিয়ে টিভিতে সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন৷

ইতিহাসও কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবলে রাজনীতি ঢুকে পড়ার সাক্ষ্যই দিচ্ছে৷ ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পরপরই ইরানের সঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক চরম আকার ধারণ করে৷

প্রায় ২০ বছর পর ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপে দুই দল মুখোমুখি হয়৷ এই খেলার আগে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা৷ সে সময়ের ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশটির খেলোয়াড়দের উদ্দেশে বলেছিলেন, খেলা শুরুর আগে ইরানের খেলোয়াড়দের অবশ্যই আমেরিকার ফুটবলাদের সঙ্গে করমর্দন করা উচিত নয়৷

কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে ওই খেলার আগে প্রত্যেক ইরানি খেলোয়াড় আমেরিকান খেলোয়াড়দের ফুল উপহার দিয়েছিলেন৷ খেলার কাছে প্রতিহিংসার রাজনীতি হয়ত পরাজিত হয়, কিন্তু উত্তেজনা থেকেই যায়৷

১৯৮২ সালে নিজেদের সীমানার ৩০০ মাইল দূরে ফকল্যান্ড দ্বীপ দখল করে আর্জেন্টিনা৷ দ্বীপটি ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল৷ ফলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়৷ দু`পক্ষের ৯০০ লোকের প্রাণহানি হয়৷ এর চার বছর পরে ভাগ্যের ফেরে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে দু`দেশের দেখা হয়ে যায়৷ ওই বিশ্বকাপের নায়ক মারাদোনা পরবর্তীতে বলেছিলেন, ইংল্যান্ডের সঙ্গে ওই ম্যাচ জেতার ক্ষেত্রে ফকল্যান্ড যুদ্ধে নিহত আর্জেন্টাইন সেনাদের মুখচ্ছবি তাকে প্রেরণা দিয়েছিল৷

১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ ছিল অদ্ভুত৷ পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্ট ভাবধারার দেশগুলোর মধ্যে চলছিল স্নায়ুযুদ্ধ৷ ঠিক এ সময়ে  ইউরোপের ফুটবল পরাশক্তি ও পুঁজিবাদী ভাবধারার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন এবং পর্তুগাল প্রতিযোগিতার বাছাই পর্বেই বাদ পড়ে৷ তাদের বদলে বিস্ময়করভাবে ইউরোপ থেকে বিশ্বকাপে ঠাঁই নেয় সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া এবং পূর্ব জার্মানি৷

ওই বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে মুখোমুখি হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি৷ ফুটবল দক্ষতায় পশ্চিম জার্মানি অনেক এগিয়ে থাকলেও পূর্ব জার্মানি সেবার ১-০ গোলে জিতেছিল৷ অবশ্য পরে বিশ্বকাপটি জিতেছিল পশ্চিম জার্মানি৷

২০০৬ সালে বিশ্বকাপে অ্যাঙ্গোলা-পর্তুগালের খেলাকে ঘিরেও যথেষ্ট উত্তেজনা ছড়িয়েছিল৷ ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা লাভের আগে অ্যাঙ্গোলা প্রায় ৫০০ বছর পর্তুগিজ উপনিবেশ ছিল৷ ২০০১ সালে দু`দেশ এক বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল, তবে পরে ম্যাচটি ঘিরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়৷ ম্যাচটিতে অ্যাঙ্গোলার চারজন খেলোয়াড় লালকার্ড দেখার পর সংঘর্ষ শুরু হয়৷ পরে ৬৭ মিনিটে ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয়৷ পর্তুগাল ৫-১ গোলে জেতে৷

২০০৬ সালের বিশ্বকাপে অবশ্য কোনোরকম অঘটন বা লালকার্ড ছাড়াই খেলা শেষ হয়েছিল৷

রাজনীতি আর খেলার মধ্যে সম্পর্ক বাংলাদেশের দিকে তাকালেও পাওয়া যাবে৷ আমাদের দেশে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থক বেশি থাকার একটি বড় কারণ সম্ভবত তারাও আমাদের মতোই গরিব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে বিশ্বকাপে৷

রাজনৈতিক দর্শন থেকে, এমনকি পশ্চিমা ক্লাব ফুটবলও বাদ যায় না৷ সে আলোচনা করতে গেলে লেখা দীর্ঘ হবে৷ আশার কথা এই যে, বিগত চার-পাঁচ দশকে প্রতিহিংসার রাজনীতি ফুটবলের সৌন্দর্য্যে শঙ্কা তৈরি করলেও, শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছে খেলারই৷

সূত্র: ডয়চে ভেলে

একে//