আল মাহমুদের মহাকাব্য লেখার স্বপ্ন কাঁদে বিছানায়
আলী আদনান
প্রকাশিত : ০৬:২৯ পিএম, ১৪ জুন ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৪:৪৩ পিএম, ২৪ জুন ২০১৮ রবিবার
মগবাজারের অন্য দশটা বাড়ির মতো সাধারণ একটি বাড়ির দোতলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন তিনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। পাঁচ ছেলে তিন মেয়ে দেখভাল করেন। দেখভাল বললে ভুল হবে, অনেকটা আগলে রেখেছেন বাবাকে। বাবা এখন কথা বলতে পারেন না। ক্ষিধা, বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কিছুই অনুভব করেন না। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটান। পরিবারের সদস্যরা কোনো কারণে ডাকলে বা কথা জিজ্ঞেশ করলে ইশারায় জবাব দেন। এতকিছুর মাঝেও তাঁকে যখন কানের কাছে বলা হলো একুশে টিভি অনলাইন থেকে সাংবাদিক এসেছেন, তখন তিনি চোখ খুলে তাকালেন।
বলছি বাংলা সমকালীন সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল কবি আল মাহমুদের কথা। যিনি নতুন চেতনায়, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলা কবিতাকে একটি নতুন কাঠামো দিয়েছেন। কবিতায় গদ্যশৈলী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাসের পাশাপাশি আরেকটি শক্তিশালী নাম যদি বলতে বলা হয় তিনি কবি আল মাহমুদ।
মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যকে একদিকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন তেমনি ছিলেন দাপুটে সাংবাদিক-সম্পাদক। তাঁর হাত দিয়ে সম্পাদিত হয়েছে সত্তরের দশকের অন্যতম জনপ্রিয় দৈনিক গণকন্ঠ। একে একে লিখেছেন কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে উঠো, সোনালি কাবিন, লোক লোকান্তরের মতো কাব্যগ্রন্থ।
বাংলা সাহিত্যের বিরল সৃষ্টি সোনালি কাবিন তাঁকে এনে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তা। সেই কবি এখন অসহায় শিশুর মতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পার করছেন জীবনের শেষ সময়গুলো। নিজ হাতে খেতে পারেন না। উঠে বসতে পারেন না। চলাফেরা তো নয়ই।
কবির শেষ ইচ্ছা কি পূরণ হবে
পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য মহাকাব্যের সংখ্যা চারটি। তার মধ্যে দুটি বাংলা ভাষায় লিখিত রামায়ন ও মহাভারত। মহাকাব্যের গুণবিচারে পাশ্চাত্যে `ইলিয়ড’ ও ‘ওডিসি` বেশ জনপ্রিয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ মহাকাব্য হিসেবে কতোটুকু সফল সে নিয়ে সাহিত্য সমালোচকরা এখনো বিতর্কে মাতেন। তবে বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এসে একজন কবি মহাকাব্য লিখার কাজে হাত দেন। তিনি শক্তিমান কবি আল মাহমুদ। সুস্থ থাকা অবস্থায় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন মহাকাব্য লেখার কাজ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। এরমধ্যেই কবি মাইল্ড স্ট্রোক করলেন। ধকল কাটিয়ে উঠলেও ডাক্তার কড়া নিষেধ করে বললেন মস্তিকে কোনো চাপ না নেওয়ার জন্য। কবিকে আগে সুস্থ হতে হবে। তারপর লেখালেখি।
কিন্তু কবির স্বাস্থ্যের ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। কবি এখন অনেক ইচ্ছার বাইরে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কবির শেষ ইচ্ছা কী তাহলে পূরণ হবে না? বাংলা সাহিত্য কি পাবে না আধুনিক বাংলায় রচিত একটি মহাকাব্য?
এক দুপুরে কবির বাসভবনে
কবি আল মাহমুদ- এর বড় সন্তান মীর শরীফ মাহমুদ। দুপুরে বাসায় গেলে তিনিই এ প্রতিবেদককে নিয়ে বসালেন সরাসরি কবির রুমে। কবি তখন গভীর নিদ্রায়। কবিপুত্র তাকে কয়েকবার ডাকার পর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, ‘আব্বা, একুশে টেলিভিশন অনলাইন থেকে আপনাকে দেখতে এসেছেন।’ কবি উঠে বসার চেষ্টা করলে তাঁকে নিবৃত্ত করলেন ছেলে। কাছে গিয়ে এ প্রতিবেদক বসলে কবি ইশারায় হাত নাড়লেন। তারপর আবার গভীর ঘুম। এই ফাঁকে কথা হলো কবিপুত্রের সঙ্গে।
কবিপুত্র জানালেন, তাদের মা নাবিলা মাহমুদ ২০০৯ সালে সংসার ও স্বজনদের মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান পরপারে। স্ত্রীর বিদায় মেনে নিতে কষ্ট হয়েছে বিশুদ্ধ প্রেমিক হৃদয়ের কবি আল মাহমুদের। তারপর থেকেই তিনি চুপচাপ স্বভাবের হয়ে যান। এমনিতেও কবি চাপা স্বভাবের। কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যু কবির চারপাশে যে একটা অদৃশ্য শুন্যতা তৈরি করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারপর ধীরে ধীরে বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। গত দু`তিন বছর নিজ হাতে লিখতে পারতেন না। শ্রুতি লিখনেই কাজ চলতো।
কবিপুত্র মীর শরীফ মাহমুদ আরও জানালেন, গত কয়েক বছর কবি শারিরীক কারণে ঈদের জামাতে যেতে পারেন নি। অন্য দশটা সাধারণ বাঙালি পরিবারে যেভাবে ঈদ আসে সেভাবেই ঈদ নামে কবি পরিবারে। মানুষজন আসেন। কবিকে সালাম করেন। কবির দোয়া চান। কবি চুপচাপ খাটে বসে থাকেন। শিশু সুলভ সরলতায় কথা বলেন।
কবির সর্বশেষ বই বের হয়েছে এবছরের বই মেলায়। আত্মজৈবনিক উপন্যাস `জীবন যখন বাঁক ঘোরে`। এ বইটিও শ্রুতি লিখন। অবশ্য বই ছাপার কাজ শেষ হওয়ার আগেই মাইল্ড স্ট্রোক করেন কবি। নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক আবদুল হাই কবির নিয়মিত চিকিৎসক। এখনো প্রতিনিয়ত রুটিন ওয়ার্ক করেন তিনি।
চিকিৎসকরা কবিকে সব ধরনের খাবারই খেতে বলেছেন। তবে কবি খুব অল্প পরিমানে খান। খাদ্যতালিকায় সাধারণত যা থাকে তা হলো দুধ, সেদ্ধ ডিম, নুডলস, রুটি, কলা, ভাত, মুরগী, সবজি ইত্যাদি। দেশী মুরগী কবির খুব পছন্দ। ডাক্তারের পরামর্শ মতো কবিকে তিন বেলা ওষুধ খাওয়ানো হয়।
কবিপুত্র মীর শরীফ মাহমুদ জানালেন, আল মাহমুদের ডায়াবেটিস নেই। প্রেসারের কোনো সমস্যাও নেই। মাইল্ড স্ট্রোক করলেও সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠেছেন। শরীরে অন্য কোনো রোগ নেই। তাহলে? কবির সব রোগ বার্ধক্যজনিত। বার্ধক্য কবির বাকশক্তি, শ্রবন শক্তি কেড়ে নিয়েছে। আর দৃষ্টি শক্তি? সেটা কবি অনেক আগে বই পড়ে পড়ে নিজেই শেষ করেছেন।
কবির পরিবার
কবি আল মাহমুদ ব্যাক্তি জীবনে আট সন্তানের জনক। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে সবাই বিবাহিত। বড় ছেলে মীর শরীফ মাহমুদ আগে সাংবাদিকতা করতেন। এখন কিছুই করেন না। দ্বিতীয় সন্তান মীর মোহাম্মদ আরিফ, পেশায় ব্যবসায়ী। তৃতীয় সন্তান মীর মোহাম্মদ তারেক। পেশায় বীমা কর্মকর্তা। আতিয়া মীর কবি আল মাহমুদের চতুর্থ সন্তান। তিনি গৃহিনী। তার স্বামী ব্যবসায়ী। কবির পঞ্চম সন্তান তানিয়া মীর। তার স্বামীও একজন ব্যবসায়ী। জিনিয়া মীর কবির ষষ্ঠ সন্তান। তার স্বামীও একজন ব্যবসায়ী। কবির সপ্তম সন্তান মীর মোহাম্মদ মনির একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিষ্ট্রার হিসেবে কর্মরত। কবির কনিষ্ট সন্তান মীর মোহাম্মদ আনিস। একটি বেসরকারি ব্যাংকে তিনি ইভিপি হিসেবে কাজ করছেন।
কবির বড় সন্তান মীর শরীফ মাহমুদ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমরা মায়ের শাসনে মানুষ হয়েছি। বাবাও শাসন করতেন। তবে বাবা ছিলেন নরম প্রকৃতির মানুষ। তিনি কখনো কঠোর ছিলেন না। মীর শরীফ মাহমুদ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে আরও জানান, বাবা কখনোই হিসেবি সাংসারিক ছিলেন না। তিনি পড়াশুনা, সাহিত্য চর্চা এসবকে প্রাধান্য দিতেন। সংসারের জটিল মারপ্যাঁচ কখনোই তাকে স্পর্ষ করে নি। কবি বর্তমানে যে ফ্ল্যাটে বাস করেন সেটি কবি পরিবারের নিজদের সম্পত্তি। ২০০৪ সালে কবি পরিবার সেটি ক্রয় করেন।
আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবাদ পুরুষ কবি আল মাহমুদ সুস্থ হয়ে উঠুক, আবার সক্রিয় হোক তার কলম সেটাই প্রত্যাশা।
/ এআর /