আন্ত:সম্পর্ক, ভূরাজনীতি, সীমান্ত ও ভালোবাসা
গোলাম সারোয়ার
প্রকাশিত : ০৭:৫২ পিএম, ১৭ জুন ২০১৮ রবিবার
মধ্যযুগের বাংলার এক মহান কবি বড়ু চণ্ডীদাস বলে গিয়েছেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এই বাণী তাঁর জন্মের আগে কিংবা পরে মানব ইতিহাসের সর্বকালেই প্রাসঙ্গিক এবং বর্তমানে সভ্যতার এই নাজুক সময়ে এটি আরো ব্যাপক প্রাসঙ্গিক। বাঙালীর বিশ্বকে দেওয়ার মতো এটিই সম্ভবত সবচেয়ে দরকারী ম্যাসেজ। মানব ইতিহাসে বাঙালীর আরো বহু অবদান আছে। তবে গত শতাব্দী থেকে বিশ্বকে বাঙালী তথা ভারতীয় উপমহাদেশ যা দিতে পেরেছে তার ভিতরে সবচেয়ে বড় দান হলো রবীন্দ্রনাথের চিন্তা।
ভারত বিশ্বের বিরল বহুত্ববাদী একটি বিশাল দেশ। এই সমগ্র উপমহাদেশকে এক রবীন্দ্রনাথই ধারণ করেছেন পরম আদরে, পরম যত্নে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথ আমাদের পৃথিবী ছেড়ে চলে যান কিন্তু আমরা যখনই বিপদে পড়েছি, পথ খুঁজেছি, তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে এসেছেন আমাদের দিশা দিতে। আমরা কিছুটা তাঁকে বুঝতে পেরেছি, কিছুটা পারিনি, কিছুটা বুঝেও মানিনি কিংবা মানতে পারিনি। যদি মানতে পারতাম তবে বিশ্বকে আমরাই নেতৃত্ব দিতে পারতাম ধনে মানে জ্ঞানে বিজ্ঞানে দর্শনে। ১৯৪৭ সালে আমরা যখন ভাগ হচ্ছি তখনো রবীন্দ্রনাথ আমাদের সামনে এসেছিলেন তাঁর ১৯১১ সালের বলে যাওয়া সেই স্তোত্রগুলো নিয়ে, ‘পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ/ বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ। অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী/ হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী। পূর্ব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে, প্রেমহার হয় গাঁথা/ জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!’-এই মন্ত্র আমাদের সামনেই ছিলো। আমরা পড়েছি, তবে মানিনি। আমরা তখন বড়ু চণ্ডীদাসের মানুষ না হয়ে, হয়ে যাচ্ছিলাম ধর্মী আর রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় না হয়ে হয়ে যাচ্ছিলাম অচেনা অজানা জাতির কৃতদাস। সেই অপরাধে গত সাতদশক ধরে আমরা দিকভ্রান্ত আর ভ্রাতৃঘাতী উৎভ্রান্ত।
সাতচল্লিশে মানব ইতিহাসের সব অর্জনকে উপেক্ষা করে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে জন্ম হলো ভারত আর পাকিস্তান। ভাগ হলো প্রায় পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। ভাগের উন্মাদনায় প্রাণ হারালো দুই তিন কিংবা পাঁচ লাখের অধিক মানুষ। বাস্তুচ্যুত হলো প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ, ঘটলো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দেশত্যাগের ঘটনা। বাটোয়ারা হলো ৪০ কোটি মানুষ। ভাগ হলো মাটি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, এমনকি কয়েকমাস আগে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে আসা ৬০টি হাঁসও।
পাকিস্তান, প্রায় বারশ মাইল দূরত্বের দুটি ভূখন্ড নিয়ে গঠিত একটি বিরল কিম্ভুতকিমাকার রাষ্ট্র, যার মাঝে আর একটি বিশাল দেশ ভারত। পূর্ব ও পশ্চিম দুই পাকিস্তানের মাঝে শুধু ভৌগোলিক দূরত্ব নয়, ছিলো ভাষার দূরত্ব, সংস্কৃতির দূরত্ব। ছিলো মূল্যবোধে, বিশ্বাসে আর চিন্তায় দূরত্ব। শুধু মিলের মাঝে মিল হলো ধর্ম। পাকিস্তান তখন ধর্মোন্মাদ। তাদের আইনসভা তখন যেন ধর্মসভা। কিন্তু এভাবেতো চলতে পরেনা। এই ভুল ভাংতে দেরিও হলোনা। মাত্র চব্বিশ বছরে আমরা আমাদের চেতনা ফিরে পেলাম। সেই মসিবতের সময়, সেই পূণর্জন্মের মুহূর্তেও আমরা আবারো আবিষ্কার করলাম; আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের মাটির টান আর আমাদের রবীন্দ্রনাথই আমাদের দিশা দিচ্ছেন।
বাস্তবিকই বাঙালীর আজো আপনজন রবীন্দ্রনাথ। ভূ-রাজনীতি বিশেষজ্ঞগণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কৌশলবিদগণ বহু হিসেব দিতে পারেন কিন্তু মাটির গন্ধ শুঁকে আমরা আজো বলে দিতে পারি, আজো বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথসম্পদগুলোর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ৫৪টি অভিন্ন নদী নয়, একই আবহাওয়া- জলবায়ু নয়, এমনকি ৪,১৫৬ কিলোমিটারের সীমান্তরেখাও নয়। এখনো আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যৌথমূলধন হলো রবীন্দ্রনাথ।
শান্তি নিকেতনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর `বাংলাদেশ ভবন` উদ্বোধনে এটি আবারো প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতার পালে প্রচুর হাওয়া। এই কাজে এখানে উইন্ডমিলেরও দরকার হয়না। কিন্তু সত্য হলো, জন্মের পর থেকে ভারত তার স্থল ও জল সীমান্ত মিলে যে ১০টি দেশের সাথে সীমান্তিক মনস্তত্ত্বে লড়ে যাচ্ছেন তার ভিতরে একমাত্র বাংলাদেশের জন্যেই তারা এ যাবত সবচেয়ে বেশি উৎসর্গ করে গেছেন। এই সত্য আমরা আজো বুঝতে পারিনি। গত সাতচল্লিশ বছরে আমরা জাতিকে বহু ভয় দেখিয়েছি ভারত বাংলাদেশ দখল করতে চায় বলে। কিন্তু সত্য হলো আমরা সাতচল্লিশ বছরে বহু দুর্বল সময় অতিক্রম করে এসেছি। কিন্তু ভারত আমাদের সীমান্তের এক বর্গইঞ্চি জায়গাও আজো দখলে নেয়নি।
আমাদের স্বীকার করতে হবে, ভারতের রক্তে, অর্থে আর শক্তিতে মুক্তিযুদ্ধে লড়ার অসীমসাহস পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আমরা আমাদের শত্রুর বন্ধু চীন থেকে অবিরাম অস্ত্র কিনে গেছি , শত্রুর সাথে চুক্তি করে গেছি। আমাদের জন্মের বিরোধিতাকারীদের থেকে আমরা সাবমেরিন কিনে গেছি, পণ্য কিনে গেছি অকাতরে চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হিসাব ছাড়া কিন্তু ভারত মাটি টানে সেই শুরু থেকে আমাদের প্রতি আজো প্রতিশ্রুতিটা ধরে রেখেছেন। পঁচাত্তরের মহাবিপর্যয়ের পর তাঁরা অবাক হয়েছেন, বিস্মিত হয়েছেন, হয়তো আবেগের সম্পর্কটাকে বাস্তাবতায় আর বিবেকের কাঠগড়ায় নিয়ে গেছেন কিন্তু সম্পর্কটাকে একেবারে চুকিয়ে ফেলেননি।
বর্তমান বিশ্বে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি শরণার্থীকে বিশ্বের সবরাষ্ট্র মিলেও নিতে পারতেছেনা। কিন্তু একাত্তরে সেই অভাবের যুগেও ভারত একাই এক কোটি শরণার্থীকে নিয়েছিলো। এশিয়ার লৌহমানবী ইন্দিরা গান্ধীর মতো মহামানবীর জন্ম না হলে সেদিন এই বিপন্ন মানবস্রোত কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো একমাত্র আল্লাহই জানেন! তারপর উৎপীড়িত জাতির মুক্তির জন্যে তাঁরা লড়েছেন অকাতরে, বিনে হিসেবে রক্ত দিয়ে, সম্পদ দিয়ে আর জীবন দিয়ে। মুক্তিবাহিনী, মুজিববাহিনী, ভারতীয় বাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধে হয়ে গিয়েছিলো একাকার, ভাই-ভাই। বিনিময়ে ভারত কিন্তু কিছু দাবি করেনি। যুদ্ধ শেষে ফিরে গিয়েছে নিজ ভূবনে। পরিহাস হলো, আমাদের দেশের কিছু ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের আজকের যুগের প্রাণভোমরাই হলো ভারত বিরোধিতার পুঁজি।
ভারত দল হিসেবে আওয়ামীলীগকে বিশ্বাসে পেয়েও অন্যদলগুলোর শাসনের সময়েও রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারের তেমন ব্যত্যয় করেননি। পঁচাত্তরের পনের আগস্টের বাঙালীর মহাবিপর্যয়ের পর প্রথম শোক সভাটি হয় ভারতে। দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে শোকসভা করেছিলেন। তিনিই বলেছিলেন, শেখ মুজিব সোনার বাংলা গড়ে তোলার এবং উপমহাদেশে শক্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনের কাজে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি এও বলেছিলেন, শেখ সাহেব গোটা বিশ্বেই মহান জাতীয় নেতা। তিনিই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সেই কঠিন সময়ে যখন তাঁদের পৃথিবী হয়ে গিয়েছিলো এতটুকু। কিন্তু বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর পরও ভারত বাংলাদেশকে ছেড়ে দেয়নি। ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান দিল্লির আমন্ত্রণে ভারতে গেলে তাঁকে রাষ্ট্রপতিভবনে নৈশভোজে অ্যাপ্যায়িত করেছিলো ভারত।
গত সাতচল্লিশ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু অঘটন ঘটে গেছে, বহুবার বিশ্বাস টলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো। তবুও এখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রটোকল ভেংগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আতিথ্য দেওয়া হয়। এশিয়ার আর কোন দেশের নেতা এই মর্যাদা ভারতের নিকট থেকে পায়না। এই সময়েইও আমাদের দুই দেশের অনেক প্রাপ্তি আছে। আমরা ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি-বণ্টন চুক্তি, ২০১৫ সালের স্থলসীমানা চুক্তি, চিটমহল বিনিময়, আমাদের দু’দেশের মাঝের বর্ধিষ্ণু জন-যোগাযোগ, স্থল রেল জল পথে যোগাযোগ, আমাদের ইতিহাস, ভূগোল, ভাবাবেগ আর স্বার্থকে আরো কাছে নিয়ে আসবে। ভারত আসলে একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ চায়, যা স্থিতিশীল ভারতের জন্যে দরকারী। ভারত চায় তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নবাদীরা বাংলাদেশে প্রশ্রয় না পাক, ভারত চায় ঐ দুর্গম অঞ্চলের উন্নয়নে বাংলাদেশও অংশগহন করুক, সেখানে মানবিক পণ্যগুলো পৌঁছাতে বাংলাদেশ তার ভূমি ব্যবহারের অনুমতি দিক, বাংলাদেশ ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদকে নিয়ন্ত্রণ করুক। এইতো! গত নয় বছরে ভারত বাংলাদেশের কাছে সেগুলো পেয়েছে বা পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ চায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহায়তা, বিদ্যুত ও জ্বালানি সহায়তা, জল ও জলবায়ুর শেয়ারিং। বাংলাদেশ সেগুলোর কিছুটা পেয়েছে, কিছুটা পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে।
আমাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি, জলবায়ু এক। আমরা গঙ্গায়-পদ্মায়-মেঘনায়-যমুনায়-তিস্তায় একাকার। আমরা বিশ্বাস করি এখনো বিশ্বের মূল স্থাবর সম্পত্তি জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শন। সে হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় যৌথসম্পদ হলো আমাদের চণ্ডীদাস, লালন, জীবনানন্দ, সুকান্ত, নজরুল, অবন ঠাকুর আর সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ। এইই আমাদের যৌথ ভালোবাসা। এই ভালোবাসা দিয়ে সবই জয় করা সম্ভব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
এসি