ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

বাবারা কি সারাজীবনই পুড়েন 

ইমদাদ হক  

প্রকাশিত : ০৮:৫৭ পিএম, ১৭ জুন ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১১:১৮ পিএম, ২২ জুন ২০১৮ শুক্রবার

শৈশব, কৈশোর আর যৌবন... চোখের সামনে পার হয়ে গেলো সব। বয়সের হিসেবে যৌবনের দুরন্তকাল চলে এখন।     

নাটোরের বড়াল নদীর তীরে এক অখ্যাত পাড়া গাঁয়ে বাড়ি আমাদের। ছোট এক কৃষকের ঘরে একান্নবর্তী পরিবারে দু‘ভাই আর এক বোনের সংসারে ছোট আমি।

সংসারের সম্পদ বলতে অল্প কিছু জমিজমা। তাতে চাষাবাদ, সাথে বর্গা নেওয়া আরো কিছু জমি। তাতেও যখন হয় না, তখন অন্যের জমিতে বাবার কামলাগিরি।

হেমন্তের শেষ দিকে সারাগ্রাম জুড়ে চলতো নবান্ন উৎসব। শান্তা চাচা, মফিজ খালু বা ফরহাদ ভাইদের জমিতে তখন ধান কাটার ধুম, যেন পুরো এক উৎসব। খুব সকালে ধানের জমিতে কাস্তের খ্যাস খ্যাস শব্দে চলতো ধানকাটার হিড়িক। কে কত দ্রুত কাটতে পারে ধান, চলতো অলিখিত এক প্রতিযোগিতা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে কুদু চাচার মহিষের গাড়িতে করে তা বাড়িতে আনা। ধান মাড়াইয়ের আধুনিক যন্ত্র আসেনি তখনো। মহিষ বা গরু ঘুরিয়ে ধান আলাদা করা। আমাদের আর কতটুকুই জমি, ওজন মাপার স্কেলে কয় মণই ধান! প্রায়ই দেখতাম বাবাকে অন্যের জমিতে দিনমজুরগিরি করতে।

পাঁচ সদস্যের পরিবারের ভরণ পোষণ। বাড়িতে কেউ না কেউ অতিথি হয়ে থাকতো বলতে গেলে সারাক্ষণই, মায়ের কূলের নয়তো বাবার কূলের। তিন ভাই-বোনের পড়ালেখার খরচ যোগানো। সবকিছু সামলে নেওয়া বাবার পক্ষে সহজ ছিল না মোটেও। স্কুলের পাঠে কেবল টু থ্রি ক্লাসে পড়ি তখন। রঙিন স্লেট, লাল রঙের টুবি, থ্রিবি পেন্সিল আর মহানগরের মোটা খাতা... ১৫-২০ টাকা লেগে যেতো তাতে। সপ্তাহে হাট বসতো দুদিন, মঙ্গল আর শুক্রবার। আমার জন্য খুশির দিন। বাবার সাথে বাজারে গেলে গুঁড়ের মোওয়া আর দাঁতভাঙ্গা পাওয়া যাবে। সাথে সুযোগ মতো আমার খাতাকলম। হাটবার এলেই তাই বাবার পিছনে পিছনে ঘুরতাম। কিন্তু হাটের দিন বাবার মুখটা মলিন থাকতো প্রায়ই। মোটা চাল, তরিতরকারি, আর কখনো বা পাঙ্গাস বা সিলভার কার্প মাছ। বেশিরভাগ হাট বারেই আমার খাতাকলমের স্বপ্ন পূরণ হতো না। বাবা বলতেন, কিনে দেবো সামনে বার ঠিকই।

কচি হৃদয়ে মনখারাপের ছায়া। মুড়ি মুড়কি খেতে খেতে বাজারের ব্যাগ কাঁধে বাড়ি ফিরতাম। প্রাইমারি, হাইস্কুল বা কলেজ, বেশিরভাগ সময়ই তো কাটলো অপূর্ণ স্বপ্ন লালন করে। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়েও তো, সহপাঠীদের সাথে এক্সকারসন, ছুটিতে ঘুরতে বেরিয়ে পড়া সিলেটের জাফলং কিংবা সুন্দরবন, তাও তো হয়ে উঠেনি। হাসিমুখে বাবার কত স্বপ্ন বিনির্মাণ, বড় হলে সব পাবি দেখিস। এত ভালো কিছু পাবি, তখন আর এসব মনেই থাকবে না। স্বল্পশিক্ষিত বাবার চোখে মুখে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের ঝিলিক।

কত ঈদই তো আসে যায়। সেই ঈদের কথা ভুলতে পারি না এখনো। ত্রিশটা রোজা শেষে পশ্চিমাকাশে চাঁদ দেখা দিয়েছে। খেজুর গাছের হাওই দিয়ে ছেলেমেয়েদের আতশ বাজি, হই হুল্লোড়, ঈদ এলো, ঈদ এলো রে গানের কোরাস। এখন মনে হয়, সে সময় কেবল নীরব আর নিস্তব্ধ ছিল আমাদের পরিবারেই। রাত পোহালেই ঈদ। নতুন জামা তো দূরের কথা, সামান্য সেমাই চিনি কেনার জন্য একশ টাকা দরকার, তাও কেন জানি যোগাড় হচ্ছিল না। বাতির কালি ওঠা আলোয় আমি পড়ার টেবিলে চুপচাপ, যেন স্থির। বাবা এসে পাশে বসলেন, ‘কি লাগবে তোর।’ বাবার মুখের দিকে তাকানোর সাহস ছিল না সে সময়।

-কিচ্ছু লাগবে না বাবা।

হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। বাবা আগলে ধরেন বুকের মাঝে। বলে উঠেন, পাগল ছেলে। তুই একদিন ব্যাগ ভর্তি করে সবার জন্য শপিং করবি, ভ্যান ভর্তি করে বাজার নিয়ে আসবি। আর কটা দিন, দেখতে দেখতে চলে আসবে দেখিস।
ঘুম থেকে উঠে সকালে ঠিকই আমাদের সবার নতুন জামাকাপড় পেয়েছি। আর ঈদের প্রয়োজনীয় বাজারও এনেছিলেন বাবা। রাজ্যের দুঃখ নিয়ে ঘুমানো এই আমি, সকালে প্রিয় জুঁতা পেয়ে এত খুশি হয়েছিলাম, আর কখনো এত খুশি হয়েছিলাম কি না, মনে পড়ছে না।

আমার বাবা, স্বপ্নচারী একজন ব্যক্তি। স্বপ্ন লালন করতেন, আমাদের ভাইবোনদের মাঝে তা বিলিয়ে দিতেন। ছোটবেলায় বাবার পাশেপাশে ঘুরঘুর করতাম। বাবা গরুর লাঙল নিয়ে হই, হই, ডানে, ডানে, বামে বামে, থাম থাম করে উর্বর জমি চাষ করতেন। ঘামে নেয়ে পড়তো সারা শরীর। বাড়ি থেকে মাথায় করে বাবার জন্য ভাত আর পানি নিয়ে যেতাম। বিশ্রামের সময় বাবা খেতেন, আর গল্প করতেন। খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতাম। ভাবতাম, বাবা এত জানেন কি করে?
পড়ালেখা শেষে আজ চাকরি করি। ব্যস্ততা এতই বেশি, এক ঈদে ছুটি পেলে অন্য ঈদ কাটে অফিসেই। আজ সত্যিই, ব্যাগ ভর্তি করে সবার জন্য শপিং করি। বাবার জন্য কয়েক পস্তর কাপড় কিনি, একটা পছন্দ না হলে অন্যটা পড়বেন। আর, ঈদের বাজারসহ সংসারের প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের বাড়তি যোগান। এখন চাইলেই কিনতে পারি অনেক কিছু, ইচ্ছে হলেই ঘুরতে যেতে পারি, দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে। কিন্তু ছোট্টবেলায় ঘুম থেকে জাগার পরে দেড়শ টাকার রঙিন জুঁতা পাওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দের সিকিভাগও মনে টের পাই না। বাবা আজ বয়সের হিসাবে ভর সন্ধ্যায়। শুশ্ম্রমন্ডিত দাঁড়িতে ইবাদত বন্দেগীতেই কাটে সময় তাঁর। চেয়ে থাকেন পথপানে, কখন ছেলেমেয়ে বাড়িতে আসে?

বাবা কি আজো আমাদের দেখেন? সেই ছোট্টবেলার শুভ্রদের বড় হয়ে যাওয়া, তরতর করে পরিণত হয়ে ছোট্ট বাবুদেরই আবার বাবা হওয়া? চাইলেই বাবা এখন শুভ্রদের দেখতে পারেন না, ছুঁয়ে দিতে পারেন না ছোটছোট নাতিপুতিদের। বাবার হৃদয়টা কি পুড়ে যায়? সেই যে, ছোট্টবেলায় পুড়তো শুভ্রদের আবদার পূরণ না করতে পারায়? আচ্ছা, বাবারা কি সারাজীবনই পুড়েন এভাবে?

এখন ঈদ এলেই মনে ভয় জাগে, ছুটি পাবো তো! নানা কাজে, নানা অসুবিধায় দেশের বাড়িতে আর যাওয়া হয় না। ঈদের সময় হুহু করে মনটা। সবার কথা মনে পড়ে যায়। আজ, ব্যস্ত এই মেগাসিটিতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি নিজের পোশাকের জৌলুশ! মনে পড়ে ছোটবেলার পাওয়া না পাওয়ার ঈদের কথা, পুরনো পাঞ্চাবি টেনেটুনে ঈদগাহে যাওয়ার স্মৃতি। মনে থাকবেও সারা জীবন। মা- কে মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে বাবাকেও। কত ঈদ আসে, আসে কত বাবা দিবস, মুখ ফুটে তো কখনোই বাবাকে বলা হয় না বাবা, মিস করি তোমাকে, ভালবাসি।
নিজেকে প্রশ্ন করি, বাবার কথা মতো, সব পাবি, পেয়েছি কি সব? চাইলেই যে বাবাকে দেখতে পারি না, ছুঁতে পারি না মাকে! এটাকে কি সব পাওয়া বলে বাবা?

লেখক: বিজনেস রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর 

এসি