ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

আমার বাবা আমার আইডল

প্রকাশিত : ১০:৩৪ পিএম, ১৭ জুন ২০১৮ রবিবার

আমার বাবা মরহুম আলহাজ এম হজরত আলী, যাকে অঞ্চলের মানুষ `সাহেব` হিসেবে সম্মান করেন। এখনো কোথাও গিয়ে দাঁড়ালে আমাদের ভাই বোনদের পরিচয় জোটে বারইপাড়ার সাহেবের ছেলে-মেয়ে বলে।

আমার দাদা মরহুম সোনাউল্লাহ সরকার ছিলেন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার বারইপাড়ার অবস্হাসম্পন্ন সমাজসেবক ব্যক্তিত্ব। তিনি তার বাড়িতেই ছেলে মেয়ের পড়াশোনার জন্য যে চার কিলোমিটার দূরের বীর বাসিন্দা গ্রামের এক পণ্ডিতকে গৃহশিক্ষক রাখেন। গ্রামে কোন স্কুল ছিল না। স্কুল ছিল ৮ কিলোমিটার দূরে। দাদা তার চাচা শ্বশুর জয়েন সরকারসহ গ্রামের বিদ্যানুরাগী নিয়ে বৃটিশ আমলে বারইপাড়া প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বাবা ছিলেন সে স্কুলের প্রথম ছাত্র।

বাবা কালিহাতী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৪৮ সালে মেট্রিক, করটিয়া সাদত কলেজ থেকে আইকম পাশ করে আনন্দমোহন কলেজ ময়মনসিংহে বিকম ভর্তি হন। এসময় তিনি সরকারি ময়মনসিংহ জেলা রেভিনিউ অফিসে চাকরিতে যোগ দেন। এ অফিসের জেলা রেভিনিউ অফিসার ছিলেন সাঈদ হোসেন সাব (নামটা ভুল হতে পারে)। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি। আব্বা অংকে ও ইংরেজীতে ভালো ছাত্র হওয়ায় তিনি তার মেয়ে ডলি, পলিদের গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব দেন। আব্বার বন্ধু আওয়ামী লীগের, তখন ছাত্রলীগ নেতা পরে এমএন এ হাতেম আলী তালুকদার মাঝে মাঝেই ঐ বাসায় যেতেন। তিনি হোসেন সাব ও ডলি পলির আম্মাকে বলেন হজরত আমাদের বন্ধু। এর ফলে চাকরির পাশাপাশি আব্বার ক্লাস করার সুযোগ ঘটে। পরে ইস্ট পাকিস্তান জুট মার্কেটিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হলে বঙ্গবন্ধুর বোন আব্বাকে এই করপোরেশনের চাকরিতে যোগদানে সহায়তা করে। যা স্বাধীনতা পরবর্তীতে বিজেএমসি নামকরণ হয়, এখানে পারচেজিং অফিসার পদে যোগ দেন‌ আব্বা।

বাবার চাকরির সুবাদে আমার স্কুল জীবনে বিভিন্ন জেলায় যুক্ত হয়েছে ৭ টি স্কুল। মানুষ হিসেবে তিনি তিনি ছিলেন সৎ আদর্শবান। আব্বা আমাদের ৫ ভাই ২ বোনকেই পড়াশোনা করাতেন নিজে। পরীক্ষার রেজাল্ট দেখতেন, সে অনুযায়ী গুরুত্ব দিতেন।

আমি লালমনিরহাট মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হই ক্লাস ফাইভে, ১৯৬৬ সালে। আব্বা প্রধান শিক্ষককে বলে দিলেন নিয়ম শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করলে যেনো ক্ষমা না করা হয়। ভয়ে আমি ঠিকভাবে পড়াশোনা করে দ্বিতীয় হয়ে সিক্সে ওঠি। বাবা খুব খুশী হয়েছিলেন। বাবা আমাদের ভাই-বোনদের একটা কথা প্রায়ই বলতেন এ দেশের অসংখ্য ছেলে মেয়ে পড়ার সুযোগ পায়না, সে দিক থেকে তোমরা এটা পাচ্ছো। তিনি বলতেন, অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করো না। যখন যে দায়িত্ব পাবে তা নিষ্ঠার সাথে পালন করবে। মনে রাখবে এটাও ইবাদতের সামিল। আব্বা যে ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন, অসৎ হলে আমাদের এতো সংগ্রাম করতে হতো না। তিনি আমাদের ৭ ভাইবোনকেই উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। এর মধ্যে যে ৪ জন স্নাতকোত্তর, দুজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, একবোন গ্রাজুয়েট। পড়াশোনা শেষে আমার ৪/৫ টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপত্র আসে, কিন্তু আব্বার ইচ্ছেতেই বিআরসি `৮৩ ব্যাচে সোনালী ব্যাংকে যোগ দেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা গ্রামের বাড়িতে ছিলাম, আব্বা ছিলেন কসবার কুটিতে। তিনি সাহস দিয়ে চিঠি লিখতেন দেশ স্বাধীন হবেই। তার এই চিঠি আমাদের বাড়িতে থাকা ক্যাম্পের (৫০) জনের প্লাটুনের বন্ধুদের পড়ে শোনাতাম।

তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৭১ সালে তিনি ব্রাম্মণবাড়িয়ার ভারত সীমান্তবর্তী কুটিতে জেএমসির পারচেজিং অফিসার ছিলেন। একবার মুক্তিযোদ্ধারা কুটি বাজারের পাটের গোডাউনে আগুন ধরাতে গেলে তিনি তাদের পরামর্শ দেন, আগুন নয়, এটা আমাদের সম্পদ হিসেবে রক্ষা করতে হবে। কারণ স্বাধীনতার পর এই পাট রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যাবে। বরং কোন পাট যাতে এখান থেকে কোন কোম্পানি ঢাকা না পাঠায় তা প্রতিরোধ করতে হবে। পরে তিনি অন্যান্য কোম্পানিকে বলে দেন, হেড অফিস পাট পাঠাতে বললে বলে দিবেন রাস্তা নিরাপদ নয়। স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা ও এমএন এ সিরাজুল হক এ জন্য আব্বাকে ধন্যবাদ জানান।

আল্লাহ আমাদের পিতা মাতার কবর আজাব মাফ করে দিন।

//আরকে//