ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

বাবার রসিকতা শুনে মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন বঙ্গবন্ধু : সিমিন হোসেন

আলী আদনান

প্রকাশিত : ০৭:৩৮ পিএম, ২৩ জুন ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৭:৪৫ পিএম, ২৩ জুন ২০১৮ শনিবার

তাজউদ্দিন আহমেদকে জেল খানায় হত্যা করার পর তার সংসার চলতো বাসা ভাড়ার টাকায়। কিন্তু একটা পর্যায়ে নতুন ভাড়াটিয়া আসতে চাইতো না। তাজউদ্দিন সাহেবের বাড়ি শুনলে ভাড়াটিয়ারা ভয়ে পিছিয়ে যেতো।

এমনটিই জানালেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তাজউদ্দিন আহমেদের সন্তান সিমিন হোসেন রিমি। সম্প্রতি একুশে টেলিভিশন অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের সম্পর্কের নানা দিকও উঠে আসে তার সঙ্গে আলাপকালে।

সিমিন হোসেন রিমি জাতীয় সংসদের সদস্য। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী তিনি গাজীপুর- ৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তারও আগে উপনির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও তিনি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ও গবেষক হিসেবে তার রয়েছে একটি স্বতন্ত্র ধারা। পরিচ্ছন্ন ও নির্মোহ রাজনীতির যোগ্য উত্তরাধিকার সিমিন হোসেন রিমির সঙ্গে বাবার স্মৃতিচারণ নিয়ে সম্প্রতি কথা হচ্ছিল তার বনানীর বাসভবনে।

যুদ্ধকালীন মুজিব নগর সরকারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে যখন কারাগারে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল তখন সিমিন হোসেন রিমির বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাবার আত্মত্যাগের মধ্যে যেমন সিমিন হোসেন রিমির জন্ম তেমনি মা জোহরা তাজউদ্দিনের রাজনৈতিক সংগ্রাম, দু:সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেখতে দেখতে তার বেড়ে উঠা। ফলে একজন সাধারন রাজনীতিবিদ নন; বরং দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তিনি যেমন সচেতন তেমনি রাজনৈতিক দর্শন, মানবিক মূল্যবোধ- এর দিক থেকেও হয়ে উঠেছেন একজন আপোষহীন ব্যাক্তিত্ব।

বাবার স্মৃতিচারণ করে রিমি জানান, সংসারের চেয়ে ব্যাক্তিগত সুখের চেয়ে বাবার কাছে তার দেশ ছিল অনেক উর্দ্ধে। রিমি বা তার ভাই বোনরা তাতে অভ্যস্ত ছিলেন। ‘বাবা নেই তা আমাদের মনে হতো না।  আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। ধানমন্ডিতে আমরা যে বাড়িটাতে থাকতাম তার আশপাশে সবার সঙ্গে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আমরা সেসব বাড়িতে অবাধে আসা যাওয়া করতা ‘-যোগ করেন রিমি।

তাজউদ্দিন আহমেদের দেশপ্রেমের কথা উঠে আসে রিমির কথায়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে যখন জাতীয় চার নেতাকে কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তখন তাজউদ্দিন আহমেদ স্ত্রী কন্যাকে বলেছিলেন, আমাদেরকে ওরা হয়তো আর বাঁচিয়ে রাখবে না।

তাজউদ্দিন আহমেদের ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল। কারাগারে বন্দী থাকাবস্থায় তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। ১৫ আগষ্টের পর বন্দি থাকাবস্থায় তিনি যে ডায়েরি লিখতেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন অনেক অপ্রকাশিত কথা, কারাগারের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, তাঁর (তাজউদ্দিন) চিন্তা লিপিবদ্ধ ছিল।

৩ নভেম্বর তাজউদ্দিনসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। তার আগে স্ত্রীকে (জোহরা তাজউদ্দিন, পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অাহবায়ক) বলেছিলেন, আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার ডায়েরিটা যত্নে রেখো। কিন্তু দু:খের বিষয় ৫৬৭ পৃষ্ঠার সে ডায়েরি পরবর্তীতে কারা কর্তৃপক্ষ ফেরত দেয়নি।

অন্য দশটা সাধারণ বাঙালি পরিবারের মতো সহজ জীবন পাননি সিমিন হোসেন রিমি। বাবা-মা দু`জনেই রাজনীতি, দেশ, মানুষ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে পরিবার, ছোট ছোট ভাই বোন, সংসার সবই তাকে সামলাতে হয়েছে ছোট দুটি হাতে। মাত্র বার বছর বয়সেই পুরো পরিবার আগলেছেন।

তাজউদ্দিন আহমেদসহ কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করার পর পুরো পরিবারের উপর নেমে আসে অকথ্য মানসিক নির্যাতন। বনানীতে বাবার কবরস্থানে চারজনের বেশি যেতে দেওয়া হতো না। সিমিন হোসেন রিমির ভাষ্য, আমাদের সংসার চলতো তখন বাসা ভাড়ার টাকায়। আমাদের নিচ তলায় একটি স্কুল ছিল। একপর্যায়ে তারা স্কুলটি ওখান থেকে নিয়ে যায়। নতুন কেউ বাসা ভাড়া নিতে এলে যখন শুনত এটি তাজউদ্দিন সাহেবের বাড়ি তখন তারা ভয়ে পিছিয়ে যেতো।

পদে পদে এতো বাধা, তবু রাজনীতি থেকে নিবৃত্ত হয়নি পরিবারটি। দেশের অন্য অনেক রাজনৈতিক পরিবারের তুলনায় এ পরিবারের সদস্যরা সব সময় ছিল সততা ও ন্যায়ের প্রশ্নে আপোষহীন। সিমিন হোসেন রিমির ভাষায়, ‘মানুষের সঙ্গে একটু ভালো করে কথা বললে, ভালো ব্যবহার করলে তারা অনেক খুশি হয়। তাদের জন্য কাজ করতে পারার মধ্যে আছে এক ধরনের সুখ।

বাবার আকাঙিক্ষত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, না, আমরা সেই লক্ষে এখনো পৌঁছুতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদেরকে বারবার নানা ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বারবার বাধা এসেছে। ফলে লক্ষে পৌঁছানো বিঘ্নিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দিন রাজনৈতিক সংগ্রামের ঘনিষ্ট জুটি। ফলে তাদের ঘনিষ্টতা গড়িয়েছিল পারিবারিক পর্যায়েও। উভয় পরিবারের আন্তরিকতার কারণে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিয়ে সিমিন হোসেন রিমির আছে অনেক স্মৃতি।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সিমিন হোসেন রিমি জানান, মুজিব কাকু আমাদের বাসায় সবচেয়ে বেশি আসতেন ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুথানের সময়। আমাদের বাসায় ছোট্ট একটি বাগান ছিল। বঙ্গবন্ধু ও বাবা দু`জনেই সেই বাগানে পায়চারি করতেন। দেশ নিয়ে রাজনীতি নিয়ে নানা পরিকল্পনা সাজাতেন। তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই। দেশকে স্বাধীন করা।

স্মৃতিচারণের একপর্যায়ে সিমিন হোসেন রিমি জানালেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে তাজউদ্দিন আহমেদ রোড এক্সিডেন্ট করেছিলেন। ঘটনাটা ছিল এরকম। সাভার এলাকায় নির্বাচনী প্রচার শেষ করে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে চড়ে তাজউদ্দিন আহমেদ ও আরো বেশ কয়েকজন ঢাকায় ফেরার পথে গাড়িটি এক্সিডেন্ট করে। গাড়িতে তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন না। সেই এক্সিডেন্টে তাজউদ্দিন আহমেদের পায়ের আঙুল ভেঙ্গে যায়। সবাই কম বেশি আহত হন। গাড়ি চালকের পাঁজরের তিনটি হাড়ও ভেঙে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হন্তদন্ত হয়ে তাজউদ্দিনকে দেখতে এসেছিলেন।

জাতির জনককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সিমিন হোসেন রিমি জানালেন আরেকটি ঘটনার কথা। তাজউদ্দিন আহমেদ- এর ছিল তিন মেয়ে। তিনি মেয়ের পর জন্ম নেয় এক ছেলে তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ (পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হন)।  ছেলের জন্মের পর তাজউদ্দিন রসিকতা করে বলছিলেন আমার তিন মেয়ের জন্মের পর আমি মানুষের কাছে মিষ্টি নিয়ে গেছি। এখন আমার ছেলে হয়েছে। মানুষ আমার কাছে মিষ্টি নিয়ে আসুক। এ কথা চাপা থাকলো না। পৌঁছালো বঙ্গবন্ধু`র কানে। বঙ্গবন্ধু কয়েক টুকরি মিষ্টি কিনে স্বভাবসুলভ হৈ-হুল্লোড় করতে করতে হাজির হলেন তাজউদ্দিনের বাড়িতে।

সেই সময় স্মৃতি রোমন্থন করে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, সোহেল তাজ খরগোস খুব পছন্দ করত। তখন গণভবনের নাম ছিল করতোয়া। ১৯৭৫- এর জুন মাসে বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে কাঠের বাক্সে করে সোহেলের জন্য কয়েকটি খরগোসও পাঠিয়েছিলেন।

তাজউদ্দিন আহমদকে সিমিন হোসেন রিমির মূল্যায়ন, বাবা ছিলেন শান্ত স্বভাবের মানুষ। কারো প্রতি রাগ করা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ।

রিমি জানান, খন্দকার মোশতাকের নানা কর্মকান্ড নিয়ে তাজউদ্দিন আহমেদের মধ্যে একটা শঙ্কা ছিল। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার চেষ্টা তার মধ্যে অন্যতম।

সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ১৯৭৩ সালে বাবাকে মন্ত্রীসভা থেকে সরে যেতে হলো । সেই খালি জায়গা পূরণ করার জন্য খন্দকার মোশতাক সক্রিয় হলেন। কিন্তু সেই মোশতাকই শেষ পর্যন্ত ছোবল মারলেন।

রিমি দাবি করেন, ১৫ আগষ্টের পেছনে যেমন খন্দকার মোশতাক কলকাঠি নেড়েছেন তেমনি ৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের ( ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন অাহমেদ, এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কে কারাগার প্রকোষ্টে হত্যা করা হয়।) সঙ্গে খন্দকার মোশতাক গংয়ের নির্দেশ কাজ করেছে।

তাজউদ্দিন আহমেদের দর্শন তরুণদের তকটা ছুঁয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সিমিন হোসেন রিমি সক্রেটিসের উদাহরণ টেনে বলেন, আড়াই হাজার বছর পর আমরা সক্রেটিসের ইতিহাস ও দর্শন নিয়ে গবেষণা করছি, কাজ করছি। আড়াই হাজার বছর আগে কিন্তু এটা সম্ভব হয়নি। কারণ, সমসাময়িক কালে ইতিহাস রচনা করাটা খুব দুষ্কর।

আমার বাবা ( তাজউদ্দিন অাহমেদ) নিজেই ১৯৭২ সালে প্রথম বিজয় দিবসের আগে দৈনিক বাংলায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সম সাময়িককালে ইতিহাস রচনা করা খুব মুশকিল। কারণ তাতে জীবিত ব্যাক্তিদের সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে। জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হতে পারে। এই কারণে আমি মিথ্যা বলব না, সত্য গোপন করতে পারি।’

/ এআর /