ঢাকা, শনিবার   ০৫ অক্টোবর ২০২৪,   আশ্বিন ২০ ১৪৩১

কোটা সংস্কার আন্দোলন: এবার থামলে ভালো লাগে  

এম.এস.দোহা

প্রকাশিত : ০৭:৫৯ পিএম, ১৩ জুলাই ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:৫৮ পিএম, ১৩ জুলাই ২০১৮ শুক্রবার

কোটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, মারামারি অনেক হলো। এবার একটু থামলে ভালো লাগবে। কারণ বিগত কয়েক মাস ধরে এ নিয়ে যা হলো তা দেশ, সরকার ও আন্দোলনকারী কারো জন্যই সুখকর নয়।

এ সপ্তাহের শুরুতে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ চলছিল, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনি গুতেবেস তখন ঢাকায়। তার সাথে রয়েছে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্টও। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীর সাথে বৈঠক, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন সহ কর্মসূচী পালনে দারুণ ব্যস্ত তারা। এমন সময় কোটা সংস্কার পুন:আন্দোলন!     

সরকারকে বেকাদায় ফেলার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে কি এই মোক্ষম সময়টি কাজে লাগানো হয়েছে? এজন্য নাকি আন্দোলনকারী নেতাদের বিকাশে অলৌকিক লেনদেন হয়েছে প্রচুর! আবার কিছু অতি উৎসায়ী পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীর কর্মকান্ড বিষয়টিকে আরো ঘোলাটে করতে সহায়তা করেছে। যা রহস্যজনক।

আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনার বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছেন জাতি সংঘের মহাসচিব। ভাগ্যিস, কোটা আন্দোলনকারীদের মারধর ও সাংবাদিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট লঙ্কাকান্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে ভুলে গেছেন। এতে দেশের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও আর্ন্তজাতিক এই মুরুব্বীর কাছে রক্ষা হয়। বিষয়টি নিয়ে উৎসুক ছিলো বিএনপি। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুর চাপে তা বুমেরাং হয়ে যায়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছাত্রলীগ তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীতে হামলা চালায়। আওয়ামীলীগের নীতি নির্ধারকগণ বলছে হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী নয়। হয়তো তারা অনুপ্রবেশকারী শিবির-ছাত্রদলের সন্ত্রাসী। দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ নিজেদের ভাবমূর্তি ও দায়িত্ববোধের কথা চিন্তা না করে দেশব্যাপী প্রতিহতের নামে নোংরা কায়দায় হামলা করে থাকলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাঠগড়ায় তাদের অবশ্যই দাঁড়াতে হবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধের নামে ক্যাম্পাসে যা হলো তা এদেশে সুষ্ঠধারার ছাত্র রাজনীতিকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। সেই সাথে প্রেস্টিজ পাংচার হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সকল আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র শিক্ষকদের ছিলো ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ অভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা। সর্বশেষ ওয়ান ইলেভেনে আধা সেনা শাসিত সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠ থেকে শুরু।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রের গায়ে অন্যায়ভাবে ‘আঁচড়’ দেওয়ার দুঃসাহসতো দুরের কথা ছাত্রদের টিফিন বক্সের সাথে কেউ ধাক্কা লাগার সাহস পেতো না। কিন্তু এখন দেখলাম সবই হচ্ছে। গত ৪/৫ দিন যাবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের সাথে সম্পৃক্ত আন্দোলনকারী ছাত্রদের নতুন নতুন কায়দা ও ঢঙে শায়েস্তা করা হয়।

এত মারামারি হাঙ্গামার পরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব দর্শক। প্রক্টরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা নাকি কিছুই জানেন না। কেউ তাদের এ ব্যাপারে এখনো অবগত করেনি। প্রকাশ্য দিবালোকে কতিপয় উশৃঙ্খল ছাত্র ও সন্ত্রাসী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি শৃঙ্খলা নষ্টের কাজের ইজারা নেয় তখন প্রক্টরের কোন প্রয়োজন কি আর আছে?

ইতিপূর্বে ঢাবি’র ভিসির বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাংচুরের ঘটনা ন্যাক্কারজনক ও নিন্দনীয়। কোটা সংস্কারের আন্দোলকারীদের পুলিশে হামলার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মিডিয়ায় যথাযথ সংবাদ প্রচার নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আন্দোলনকারীদের তোপের মুখে পড়ে একাত্তরসহ কয়েকটি চ্যানেলের সাংবাদিক। ওই রাতের টিভি লাইভ অনুষ্ঠান দেখলে বুঝা যাবে আন্দোলনের ভয়াবহতা ও অগ্নিমূর্তি সম্পর্কে। 

গত ৩০ জুন কোটা সংকারের দাবীতে আন্দোলনরত ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়ে বাধা, হামলা, নাজেহালের সম্মুখীন হলেন। এটা কতটুকু শোভনীয়। সুষ্ঠ ও সুন্দরভাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মতো শান্তপূর্ণ কর্মসূচী সুসম্পন্ন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোন দায়িত্ব ছিলো না? প্রক্টর মহোদয় এ ব্যাপারে কি করেছেন? ছাত্রদের অভিভাবক হিসেবে কি দায়িত্ব পালন করেছেন ভাইস চ্যান্সলর?

গত মে মাসে কোটা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সময়পোযোগী পদক্ষেপ নেন। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন ‘কোটা’ প্রথাকে চিরতরে বিলুপ্তির। হয়তো চাপে অথবা অসন্তুষ্ট হয়েই তিনি এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও অনগ্রসর এলাকা কোটা সমর্থকদের সংখ্যাও কম নয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সহানুভুতি শতভাগ। আন্দোলনকারীদেরও এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে হয়তো নীতি নির্ধারকগনের সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা বেশী সময় লাগছিলো। 

ফলে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার লিখিত নির্দেশনা দুই মাসেও সচিবালয়ে এসে পৌছেনি। যা সাধারণ শিক্ষার্থী, তথা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের করেছে হতাশ। অতপর পুণ: আন্দোলন শুরু হলে দীর্ঘ দুই মাস পর ৩ জুলাই মন্ত্রীপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে কোটা বাতিল ও সংস্কার বিষয়ক কমিটি গঠিত হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেছেন বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিধায় একটু সময় লাগবে। আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি চুড়ান্ত রিপোর্ট দিবে। হয়তো এর মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথের দেখা মিলবে। তখন আন্দোলন, গুজব, দাবী সবকিছুই থেমে যাবে। যা দেশবাসীরও লাগবে ভালো। এ নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাস ও নির্বাচনের রাজনীতি যে নোংরা খেলা চলছে অবশ্যই এর অবসান হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও মানবাধিকার সংগঠক

এসি