মানুষ, অমানুষ ও না-মানুষের কাহিনী
শতরূপা দত্ত
প্রকাশিত : ০৮:৫২ পিএম, ১৭ জুলাই ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৯:০১ পিএম, ১৭ জুলাই ২০১৮ মঙ্গলবার
ছবি: প্রতীকী
কিছুদিন ধরে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের বিভাজন নিয়ে ভাবছি। পাঠকের সঙ্গে ভাবনাগুলো ভাগ করার লোভেই আজ কলম ধরা। আমার মনে হয়েছে, চারিত্রিক বিচারে মানুষ আসলে তিন রকম- ‘মানুষ, না-মানুষ আর অমানুষ।
মানুষ মানবিকবোধ সম্পন্ন প্রাণী বলেই মানুষ। এই মানবিকতাবোধ টুকু ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে তার আর কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু মানুষ যখন লোভে, মোহে, দম্ভে, স্বার্থপরতায় উন্মত্ত হয়ে যায়, তখন সে কী করছে, তার পরিণাম সম্পর্কে ভাবে না। লুপ্ত হয় মানবিকতা। লুপ্ত হয় অনুভূতি। আর অনুভূতিহীন ক্ষমতালিপ্সু মানুষ কী করতে পারে তা বার বার দেখেছে পৃথিবী। দেখেছে দেশে দেশে অজস্র গণহত্যায়, দেখেছে একনায়কতন্ত্র আর সামরিকতন্ত্রের আস্ফালনে। দেখেছে ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে মানবতার অপমানে। বড় বড় দেশের বড় বড় ক্ষুধার নিচে পিষ্ট হয়ে গেছে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া। আর তাই সাগরে ভেসে বেড়ায় গৃহহীন দেশহীন অসংখ্য মানুষ, সাগর তীরে মুখ থুবড়ে পরে থাকে আয়লান কুর্দি।
‘এমন অদ্ভুত নাম: মানুষ’ মানুষ.... কে রেখেছে?
তুমি তো সুস্বাদু খাদ্য আরব বসন্তে-ভাসা লিবিয়ায়,
মধ্যপ্রাচ্যে মানচিত্র বদলে, আফ্রিকা ও এশিয়াতেও
একই পরিচয়ে, সীমান্তে সীমান্তে ফেরো আশ্রয়ের
খোঁজে, প্রতিদিন পুঁজি ও ধর্মের দাঁত চিবোয় তোমাকে।’
(সেজদায়, আয়লান কুর্দি: স্বপন দত্ত)
বহু দিন আগের কথা, কাশীর রাণী একশো সখী সঙ্গে নিয়ে রাজপুরী থেকে দূরে চম্পকবন নামের এক গ্রামের ঘাটে স্নানে চলেছেন। রাণী আসবেন, তাই ঘাটের কাছাকাছি বসতি এলাকা থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাঘের দিন, শীতকাল। স্নান শেষে পাড়ে উঠে রাণীর খুবই শীত লাগতে লাগলো। আগুন জ্বালানোর জন্য সখীরা আশপাশ থেকে কাঠকুটো সংগ্রহ করতে শুরু করলো। রাণী তাদের ডেকে অল্প দূরের একটি কুটির দেখিয়ে আদেশ দিলেন, আগুন লাগিয়ে দাও ওটায়, আমি হাত-পা সেঁকে নেবো। এক সখী বাধা দিলেও রাণীর আদেশে অন্যান্যরা কুটিরে আগুন লাগিয়ে দিলো। নিমেষের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে সে আগুন ছড়িয়ে গেলো কুটির থেকে কুটিরে। পুড়ে ছাই হলো সমস্ত গ্রাম।
এই অমানুষিকতা, অমানবিকতা মেনে নিতে পারেননি রাজা। সমস্ত ধনসম্পদ কেড়ে নিয়ে রাণীকে পথে বের করে দিলেন তিনি। দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করে পুড়িয়ে দেয়া ঘরগুলো গড়ে তোলার টাকা জোগাড় করে আনতে বললেন তাকে।
`মাগিবে দুয়ারে দুয়ারে -
এক প্রহরের লীলায় তোমার
যে কটি কুটির হলো ছাড়খার
যতদিনে পার সে-কটি আবার
গড়ি দিতে হবে তোমারে।’ (সামান্য ক্ষতি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ওই রাণীর মতো মানুষের অভাব নেই আমাদের চারপাশে। এরা আসলে মানুষ নয়, অমানুষ। তারা বুঝতেই পারে না তাদের বিকৃত আনন্দের খোরাক যোগাতে গিয়ে আর কাউকে কতখানি ক্ষতির শিকার হতে হয়, ক্ষমতাবানের ক্ষমতা প্রদর্শনের উৎপাতে কত নিরীহের প্রাণ যায়। নিমেষে ধ্বংস হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম, শহর, দেশ, জীবন।
পৃথিবীর কথা বাদ দিন। আমাদের এই ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া দেশটিও এই অমানুষদের সংক্রমণে সংক্রামিত। কে যে দেশপ্রেমিক, আর কে যে নয় তা-ই বুঝে ওঠা মুশকিল। কে মুক্তিযোদ্ধা, আর কে রাজাকার, কে শুধুই কাগজের মুক্তিযোদ্ধা, বোঝা দায়। ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা দখলের লড়াই আর ক্ষমতাবানের ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ। মানুষে মানুষে অবিশ্বাস, রাজনীতি আর ধর্মের ভেদনীতিতে তৈরি হওয়া বিভেদ আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত করছে। ধর্মের বিভাজন, রাজনৈতিক মতের বিভাজন, একই মত ও পথের মানুষের মধ্যে আবার তরিকার বিভাজন, ধনী ও গরীবের বিভাজন-মানুষকে কেবলি মানুষের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে, অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। আর সেই অসহিষ্ণুতার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে নির্দোষ মানুষের ঘর, প্রাণহীন দেবতারা খণ্ডিত মস্তকে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গল্পের সেই রাণীর মতো কিছু বিকৃত রুচির অমানুষের ক্ষণিকের আনন্দে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে নারীদের, সে পহেলা বৈশাখের মতো জাতীয় উৎসব হোক আর জন্মদিনের উৎসব। ধনীর দুলালের গুলি খেয়ে মরতে হচ্ছে ভিখিরির ছেলেকে। নিজের সুখের জন্য অন্যের চরম সর্বনাশ করতে দ্বিতীয়বারভাবে না এই অমানুষেরা।
এই অমানুষদের পাশে থাকে কিছু না-মানুষের দল। এরা হয়তো ততটা ক্রুর হয়ে উঠতে পারে না, কিন্তু জোর দিয়ে নিজের মতটা, প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না। এরা রাণীর সেই সখীর দল, যারা শুধু আদেশ পালন করে। কেউ কেউ হয়তো বা ক্ষীণ প্রতিবাদ জানায়, তাদের ক্ষীণ মানবিকতাবোধ থেকে। কিন্তু সেই প্রতিবাদে দৃঢ়তা নেই কোনো। ক্ষমতাবানের জোরালো অন্যায় দাবির কাছে হার মানে সহজেই। মেনে নেয়, মানিয়ে নেয়। এই না-মানুষদের মনে কোমল অনুভূতি থাকে, থাকে স্নেহ, প্রেম, দয়া, করুণা। কিন্তু সেই অনুভূতিগুলো মুখ লুকায় হিংস্রতা আর লোভের কাছে, বিকৃত আনন্দ আর স্বার্থপরতার কাছে। সমাজে কেন যেন মনে হয় এই না-মানুষদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকেও যেন এদেরই দলে দেখতে পাই। অন্তর্গত সত্ত্বার ভেতরে মানবতা, ভালবাসা, দেশপ্রেম, সৌহার্দ্য ও সাহস থাকলেও, ব্যক্তিগত পিছুটান পরিবার বা অশক্ত স্বজনের দায়িত্ব ক্যারিয়ার তৈরির আকাঙ্খা চাকরি বা কোন সুবিধা হারানোর ভয়, স্বার্থচিন্তা এই না-মানুষদের কেবলি মানুষ হয়ে উঠতে বাধা দেয়। এদের মধ্যে অমানুষ হওয়ার মতো ক্রুরতা নেই, নেই মানুষ হওয়ার মতো গুণও।
গল্পের সেই রাজার মতো অল্প কিছূ মানুষ আছে যারা সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারে। যারা আজো বিশ্বাস রাখে মানবতায়, যারা অন্যায়ের বিচার করতে ভয় পায় না। সেইসব মানুষের হাত ধরে বেঁচে থাকে মনুষ্যত্ব। এই অল্প কিছু মানুষের জন্যই আজো পৃথিবীতে নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নামার সাহস পায় সাধারণ মানুষ। তাই হয়তো আজো শ্রদ্ধা, ভালবাসার মতো বায়বীয় অনুভূতিগুলো মানুষকে আপ্লুত করে। সেজন্যই দখলদারের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে প্রাণ দেয় গেরিলা যোদ্ধা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সাহায্য নিয়ে ছুটে যায় মানুষ, দাঙ্গা বিধ্বস্ত পাড়ায় আতঙ্কিত সংখ্যালঘু প্রতিবেশীকে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখে কেউ কেউ, পথশিশু আর ছিন্নমূল মানুষের জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান নিশ্চিত করতে নিজের সর্বস্ব পণ করে।
রবীন্দ্রনাথ বহু আগে বলেছিলেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। ... আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সব বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।’
আমিও বিশ্বাস করতে চাই, একদিন চারপাশটা মানুষের মতো মানুষে ভরে উঠবে। ন্যায়পরায়ন, মানবিক মানুষ একদিন সব অমানুষিকতা আর না-মানুষিকতাকে জয় করতে পারবে। হয়তো পাঠকও আমার সঙ্গে একমত হবেন। ভীরুর ভীরুতা, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়, লোভীর নিষ্ঠুর লোভ, বঞ্চিতের ক্ষোভ, জাত্যাভিমান এবং মানবিক ঈশ্বরের বহু অসম্মান, আজ আমাদের এ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আমরা, মানুষরাই না-মানুষ আর অমানুষ হয়ে উঠেছি দিনে দিনে। আমরা ভুলে গেছি, ঈশ্বর আসলে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। যেখানে মনুষ্যত্ব থাকে না, সেখানে ঈশ্বরও থাকেন না।
লেখক: সাংবাদিক।
এসএইচ/