আকাশে উড়ার কথা বলে, তুমি আকাশেই থেকে গেলে
সেহেলী আজিজ মৌ
প্রকাশিত : ১০:০৯ পিএম, ১৮ জুলাই ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৭:৩২ পিএম, ১৯ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার
মোবাইলে রিং হতেই বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করলো। কিভাবে যে শুরু করবো! ভাবনা গোছানোর আগেই শান্ত কন্ঠস্বর ওপ্রান্তে:
হ্যালো, পৃথুলা রশিদের মা বলছেন? প্রশ্ন নয় যেন একরাশ মেঘ ছুড়ে দিলাম ওনার দিকে। অপরপ্রান্তে তা কান্না হয়ে ঝড়ে পড়লো। জ্বি, আমিই পৃথুলার মা...আমিই। কিন্তু পৃথুলাতো....বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি রেডিওতে কাজ করি, ওনার ইন্টারভিউ নেবো এসব শুনেই বললেন, "আমি মিডিয়ার কারো সাথে কথা বলার জন্য এখনও
মানসিকভাবে প্রস্তুত নই মা। আমি বললাম, "আমার ইন্টারভিউ লাগবেনা, আপনাকে সামনা-সামনি প্রশ্ন করার আছে। দেখা করতে চাই।"
উনি বললেন, "চলে আস পৃথুলার কবরের কাছে বিকেলে।"
মিরপুর বুদ্ধিজীবি কবরস্থানের গেটে এসে ফোন দিলাম, বললেন অফিস থেকে বের হয়েছেন। কবরগুলো দেখছিলাম অনেক সময় নিয়ে, হঠাৎ মা ফোন দিলেন। পৃথুলা রশিদের মা। অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেলো ওনাকে, উনি বৃহৎ এনজিও "আশা"এর এ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর, পৃথুলার মা "রাফেজা বেগম" ইশারা করলেন ওনার পিছু যাবার জন্য। হাতে তসবী, দোয়া দরুদ পড়ে চলেছেন অবিরত। মূল কবরস্থানের ভেতর দিয়ে হাঁটছি আমরা, ডানে বামে অসংখ্য কবর। অনেকবার মোড় ঘুড়লেন তিনি।
দু-একটা ছোট প্রশ্ন করছেন সাথে,কোথায় থাক, কয় ভাইবোন, এই জাতীয়। অজানা কোনো কারণে খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো আমার, পত্রিকায়, ফেসবুকে যে পাইলটের পোশাক পড়া যে উচ্ছল তরুণীর ছবি দেখেছি, তারই কবরের মুখোমুখী হতে যাচ্ছি।
যেখানে আমরা থামলাম, সেটি অনেক ভেতরে। কবরের নেমপ্লেটে লেখা -
"মরহুমা পৃথুলা রশিদ"
আমাকে প্রচন্ড অবাক করে দিয়ে উনি (পৃথুলার মা) কথোপকথনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
"বাবু, একটু দেরী হয়ে গেলো রে আজ। আমার পাখী, এই যে আমি চলে এসেছি। ও হচ্ছে মৌ, তোমাকে দেখতে এসেছে।"
পৃথুলার কবরের সাথে মায়ের কথাবার্তা আমার জন্য অচেনা অনুভূতি। কোনো ব্যাখা নেই এই অনুভূতির।
টুল কিনে রেখেছেন মেয়েকে সঙ্গ দেয়ার জন্য, আমাকে বসতে দিলেন। বললেন," আমার ময়না পাখিটা বড্ড লক্ষী মেয়ে ছিলো, জানো মা? আমরা দুজন ছিলাম বেষ্ট ফ্রেন্ড, সব শেয়ার করতাম,সব। একটু পর পর আমরা দুজন দুজনের খোঁজ নিতাম। কখনো যদি আমি অফিস থেকে ফিরতে দেরী হতো, তখন ওরা বাপ-মেয়ে টেবিলে ভাত তরকারী সাজিয়ে বসে থাকতো। তবুও তিনজন একসাথে না হলে খেতাম না। আজো আমি আর ওর বাবা প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে থাকি,কিন্তু খাওয়া আর হয়না। বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
চোখ মুছতে গেলে বললেন, "কত মুছাবা"। সারাদিন পড়তেই থাকে, আমার বাবু আমার চোখের পানি সহ্য করতে পারতোনা।
প্রসঙ্গ ঘুরাতে পৃথুলার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, " ওর বাবা (কে, এম আনিসুর রশীদ) ও ছোট থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত ওর কাপড় ধোঁয়া-ইস্ত্রি করা সবই উনি করতেন। আমি কাঁদতে তো পারছি, সে তাও পারেন না।
আটকে গেলাম একটা কথাতেই। মা বললেন, "আমি তোমাকে আকাশে উড়বার অনুমতি দিয়েছিলাম, আকাশে থেকে যাবার নয়।"
আপনমনে আমাকে বলে যাচ্ছিলেন, "২২তারিখ ওর দুইটা ফ্লাইট ছিলো। একটা ঢাকা-চিটাগং, আরেকটা ঢাকা-কাঠমান্ডু। প্রথম ফ্লাইট শেষে আমি কল দিলাম, ও বলে- তুলা, তুলা। জিজ্ঞেস করলাম, "মানে কি খালাম্মা?"। বললেন, "ফ্লাইট খুব সফটলি ল্যান্ড করলে পৃথুলা বলতো তুলা, তুলা। আমি বললাম, "ফি আমানিল্লাহ্।"
পৃথুলার পছন্দের খাবার ডাটা চিংড়ি কিনবো বলে বাজারে গেলাম, কি মনে করে না কিনেই ফিরে আসলাম। পৃথুলার বাবাকে বললাম কিনে আনতে। পৃথুলার একটা ফোন আমার কাছে ছিলো। ওর বন্ধু দ্বীপংকর কল দিলো, বললো - পৃথুলা তুই কই রে? আমি বললাম দ্বীপংকর কি হয়েছে, ও ফোন কেটে দিলো কিছু না বলেই। এর কিছুক্ষন পরই বাড়িওয়ালার ফোন, "আপনার মেয়েকি আজ ত্রিভূবন এয়ারপোর্ট গেছে, আমি হ্যা বলাতে উনি তড়িঘড়ি করে রেখে দিলেন। এরপর ওর বাবাকে ফোন দিলাম, বাকিটা সহ্য করতে পারছিনা এখনো।
এরমধ্যেই কবরস্থান এলাকায় মাগরিবের আজান হলো, মা পানি খেলেন। পৃথুলা মারা যাবার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই রোজা তিনি। শুধু পানি দিয়ে ইফতার করবেন, আমি কিছু নিয়ে আসি বলতেই থামালেন। বললেন,
"সুস্থ্য থাকার খুব বেশী কি দরকার আছে আর?"
আমি উঠার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম, উনি অন্ধকারেও মেয়ের সাথে আরো অনেকক্ষন থাকবেন। হঠাৎ বললেন, "তুমি কিন্তু তোমার প্রশ্ন করোনি। বললাম, আমার মেয়েটাকে পাইলট বানাতে চাই। সাহস পাচ্ছিনা। উনি বললেন, "অবশ্যই, কেনো নয়। আমি চাই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে পৃথুলা রশীদ গড়ে উঠুক।
১৮জুলাই, মৃত্যুর পর পৃথুলার ১ম জন্মদিন।
সন্ধ্যার আলো আবছায়ায়, অসংখ্য সারি সারি কবরের মধ্যে দিয়ে ফিরছি আমি। এ এক অন্য আমি, পৃথুলার মা বসে আছেন কবরের পাশে। পৃথুলার বাবাও আসছেন মেয়েকে সঙ্গ দিতে। কারণ উনারা জানেন তাদের আদরের বাবু অন্ধকারে ভয় পায়।
মৃত্যুর পর পর আজ ১৮ই জুলাই পৃথুলার ১ম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন পৃথুলা রশিদ।
লেখক- আরজে, সিটিএফএম৯৬.০০
এসি