স্নায়ুযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সফল অস্ত্র যখন বিগ বার্ড
প্রকাশিত : ০১:২৭ পিএম, ১৯ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০১:২৮ পিএম, ১৯ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় ঠাণ্ডা যুদ্ধ বা শীতল যুদ্ধের সময়। এই স্নায়ুযুদ্ধ চলে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। এ সময় উভয় দেশই নানা অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের ডানবুরির পার্কিন-ইলমার নামের একটি চশমা তৈরির সরঞ্জাম নির্মাতা কোম্পানির একদল ইঞ্জিনিয়ার এ স্নায়ুযুদ্ধকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। সরকারের নির্দেশে ১৯৬৬ সালের অক্টোবর মাসে তারা এমন একটি স্যাটেলাইট নির্মাণ করে যা ছিল অত্যন্ত কার্যকরী। এ স্যাটেলাইটের একমাত্র কাজ ছিল দূরাকাশ থেকে উচ্চ রেজুলেশন সম্পন্ন ছবি পাঠানো।
প্রাক-ডিজিটাল যুগে অর্থাৎ গুগল আর্থ আসার প্রায় ৩০ বছর আগে বিভিন্ন দেশের উপর গোয়েন্দাগিরি চালানোর জন্য এ কার্যক্রম পরিচালনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গোয়েন্দা বাহিনীর এ কার্যক্রম ‘বিগ বার্ড’ ও কিহোল-৯ বলে পরিচিত। এর গোপন কোড নাম ‘হেক্সাগন’। ৭০ এর দশকে এটার জন্য পার্কিন-আমলার প্রায় একহাজার কর্মী নিরলাস কাজ করে গেছেন। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো এ সম্পর্কে তেমন কেউই কিছু জানত না।
যেমন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কক্ষপথে যাওয়ার জন্য একটি মাত্র ‘বিগ বার্ড’ স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে এটি যদি কখনো আকস্মিক হামলায় বিধ্বস্ত হয় তাহলে মার্কিন বিমান বাহিনী এক মাসের মধ্যেই সেটি পরিবর্তন করতে পারবে। এ প্রজেক্টের সাথে কাজ করা উইলিয়াম সাপেফেয়ার বলেন, আমাদের স্যাটেলাইট রাশিয়ার রাস্তায় থাকা যেকোনো গাড়ির নেমপ্লেটের ছবিও স্পষ্ট পাঠাতে পারে। মস্কোর রাস্তায় হেঁটে বেড়ানো মানুষের ছবি ১০০ মাইল উপর থেকেও তুলে পাঠাতে সক্ষম এ স্যাটেলাইট। এখানে পার্কিন-ইমলারের গবেষক, লকহেড মার্টিন স্যাটেলাইট নির্মাতারা, কোডাক ফিল্ম নির্মাতারা এবং বিমান চালকের সমন্নয়ে একটা বিশাল দল এটা নিয়ে কাজ করে।
যাইহোক, ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত এই সিরিজের মোট ২০টি স্যাটেলাইট ফিল্ম ও অত্যাধুনিক ক্যামেরাসহ ৯২ থেকে ৪২৬ মাইল উঁচুতে উৎক্ষেপণ করা হয়। এই স্যাটেলাইটের আকার ছিল একটা স্কুল বাসের মত। যার ওজন ছিন ৩০ হাজার পাউন্ড। বিগ বার্ড বা হেক্সাগন সিরিজের সবগুলোর কাজই ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও সম্ভাব্য অন্যান্য শত্রু দেশের উপর নজরদারী চালানো। তবে এটাতে কম্পিউটারের কোনো ব্যবহার ছিল না।
হেক্সাগনের নকশাকার ও নির্মাতাদের মধ্যে শীর্ষ ইঞ্জিনিয়ার পিল প্রেসেল বলেন, ‘ওই স্যাটেলাইট দিয়ে যেসব ছবি তুলে আনা হত তা আজ গুগল আর্থ থেকে যা দেখা যায় তার চেয়ে অনেক ভাল। আর এই কাজটাকে স্নায়ুযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। আমি সততার সঙ্গেই বলছি, এই গোয়েন্দা স্যাটেলাইটের কারণেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছে।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কম্পিউটার ছাড়া এটা কীভাবে ছবি তুলতো? আসলে হেক্সাগনের ছবি পাঠনোর ব্যবস্থা ছিল দুর্দান্ত। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ছবি ধারণ করতো। এতে দুটি ক্যামেরা থাকত। একটার কাজ ছিলো ম্যাপিং করা এবং অন্যটির কাজ ছবি তোলা। এখান থেকে যেসব ছবি পাঠানো হত তা ছিল ৩ ফিট প্রস্থ। এখন গুগল আর্থে দেখানো হয় মাত্র ৯.৮ ইঞ্চি। স্যাটেলাইটের পাঠানো ছবিগুলোতে সবকিছুই বিস্তারিতভাবে বোঝা যেত কারণ ওই ছবিগুলো ছিল বিশাল বড়।
এ স্যাটেলাইট ছবি ধারণ করার পর সেগুলো স্যাটেলাইট লোড নিত। এরপর সেইসব ফুটেজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্যাপসুলে ঢুকে যেত। তারপর সেই ছবি বায়ুমন্ডলে নিক্ষেপ করা হত। এরপর ৫০ হাজার ফিট উঁচু থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে হাওয়াই দ্বীপে ক্যাপসুল বা বাকেট ফিল্মগুলো নিয়ে প্যারাসুটের মাধ্যমে নিচে নেমে আসতো। সেখানে আগে থেকেই রাখা বিমান বাহিনীর সি-১৩০ বিশেষ অবতরণ স্থল থাকায় এটি নামতে কোনো সমস্যা হত না।
যাইহোক এখান থেকে পাঠানো ফিল্ম ডেপলপ করার পর সরাসরি চলে যেত যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে। তারপর মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যবাহী জাহাজ, ট্যাঙ্ক, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের ছবি দেখে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তার সিদ্ধান্ত নিত। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এই হেক্সাগন প্রযুক্তি কার্যকরীভাবে কাজে দিয়ে আসছে বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের এখনো প্রায় ১২০টি গোয়েন্দা স্যাটেলাইট রয়েছে। এসব স্যাটেলাইট মানুষের মতই গোয়েন্দাগিরির কাজ করে।
২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি এটি দেশটির বিমান বাহিনীর জাতীয় জাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে।
এমজে/