ইরান কি সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধে সক্ষম?
প্রকাশিত : ০৯:২৮ এএম, ২৫ জুলাই ২০১৮ বুধবার
ইরানের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়ে বলেছেন যে, ইরানের তেল রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া হবে৷ কিন্তু তেহরান কি আন্তর্জাতিক তেল বাণিজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পথ বন্ধে সক্ষম?
ইরানের তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার যেসর্বশেষ হুমকি ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, তাঁর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তেহরান৷ ইরানের প্রসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সেরকম কিছু করলে ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেবে৷ আরব উপসাগরে পানিপথে তেল পরিবহণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট এই প্রণালী৷ এই পথ বন্ধ করা হলে তা গোটা বিশ্বের তেল বাজারে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে৷ তেল পরিবহণে চরম বিঘ্ন ঘটবে এবং তেলের দাম মুহূর্তের মধ্যেই অনেক বেড়ে যাবে৷
ট্রাম্প ইরান চুক্তি থেকে সরে আসার পরপরই ওয়াশিংটন আন্তর্জাতিক তেল বাজার থেকে ইরানকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে এবং নভেম্বরের মধ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশকে ইরানের কাছ থেকে অশোধিত তেল কেনা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়৷
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও রবিবার আরো কঠোর পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছেন৷ ইরানের উপর বাড়তি আর্থিকনিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বলেছেন তিনি৷ তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, ইরান যদি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় এবং আঞ্চলিক সংঘাতে হস্তক্ষেপ না করে তাহলে সেদেশের উপর নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না৷
নিজের বক্তব্যে পম্পেও ইরানের উপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়াতে আন্তর্জাতিক সমাজেরও সহায়তা চেয়েছেন৷ তবে, এখন অবধি ইরান ছাড়া অন্য কোনো দেশ এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়নি৷ সেদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যামেরিকার প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানিয়েছেন যে, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের চেষ্টা করলে তার পরিণাম ভয়াবহ হবে৷
যে কারণে হরমুজ প্রণালী এত গুরুত্বপূর্ণ
পারস্য উপসাগর এবং ওমান উপসাগরকে সংযুক্ত করেছে হরমুজ প্রণালী৷ বিশ্বের অন্যতম বড় কয়েকটি অশোধিত তেল উৎপাদক দেশ এই পানিপথ দিয়েই তাদের তেল রপ্তানি করে থাকে৷ এসব দেশের মধ্যে রয়েছে কুয়েত, বাহরাইন, ইরান, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত৷
হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটি উনিশ কিলোমিটার প্রশস্ত৷ আর এই প্রণালীর শিপিং লেন তিন কিলোমিটার প্রশস্ত৷
যেহেতু শীর্ষ পাঁচ তেল রপ্তানিকারক দেশের অবস্থান আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে, সেহেতু হরমুজ প্রণালী থেকে তেল পরিবহনের পরিমাণ ক্রমশই বাড়ছে৷ কালো সোনা বাণিজ্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র পথ হচ্ছে এটি৷
সমুদ্রপথে বিশ্বের যে পরিমাণ তেল পরিবহণ করা হয়, তার এক তৃতীয়াংশই এই প্রণালী ব্যবহার করে পরিবহণ করা হয়৷ আর কাতার যেহেতু বিশ্বের অন্যতম বড় তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) উৎপাদক, সেহেতু ওই গ্যাসের প্রায় পুরোটাই হরমুজ প্রণালী দিয়ে বর্হিবিশ্বে রপ্তানি করা হয়৷
বিশ্ব অর্থনীতি যতদিন তেলের উপর নির্ভরশীল থাকবে, ততদিন এই প্রণালী থেকে তেল পরিবহনে কিছুটা বা অল্পসময়ের জন্য বিঘ্ন ঘটলেও তেলের বাজারে সেটির নাটকীয় প্রভাব পড়তে বাধ্য৷ কেননা এতে কুয়েত, বাহরাইন, ইরাক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে৷ আর সৌদি আরব তখন শুধুমাত্র লোহিত সাগরে থাকা সমুদ্রবন্দর থেকে তেল রপ্তানি করতে বাধ্য হবে৷
কিন্তু হরমুজ প্রণালী কি বন্ধ করা সম্ভব?
১৯৮২ সালে স্বাক্ষরিত জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সম্পর্কিত কনভেনশন অনুযায়ী একটি দেশের তটরেখা থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল অবধি সেই দেশের সমুদ্রসীমা হিসেবে বিবেচিত হবে৷ এখন পারস্য উপসাগরে যেতে যেসব সমুদ্রযান উত্তর এবং দক্ষিণ রুট ব্যবহারে বাধ্য হয় সেগুলোকে তাত্ত্বিক বিবেচনায় বাধা দিতে পারে ইরান৷
তবে জাতিসংঘের এসংক্রান্ত কনভেনশনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারে ইরান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ইরান সরকার ১৯৮২ সালে তাতে স্বাক্ষর করলেও সেটি কখনোই সেদেশের সংসদে অনুমোদিত হয়নি৷ তাছাড়া পানিপথটি ব্যবহারে বাধা দিয়ে ইরান তাঁর প্রতিবেশীতেল রপ্তানিকারী দেশগুলো, এবং তেল আমদানিকারক দেশগুলোর ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি করতে সক্ষম হলেও নিজেও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেননা, প্রণালীর কিছু অংশ তখন সেদেশও ব্যবহার করতে পারবে না৷
আর, তেহরান শুধু এখনই নয়, অতীতেও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে৷ মোটের উপর, এই প্রণালী নিয়ে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বহু দশক ধরেই একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে৷
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এমজে/