ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

‘এ রোগ আর কারো যেন না হয়’

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ০৬:২৫ পিএম, ২৬ জুলাই ২০১৮ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:৫৪ পিএম, ২৭ জুলাই ২০১৮ শুক্রবার

মোহাম্মদ হোসেন। বাড়ি গাজীপুর। তার মেয়ে রিতু থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। মেয়েকে রক্ত দেওয়ার জন্য নিয়ে এসেছেন ঢাকায় থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। এভাবে প্রতিমাসেই গাজীপুরের গুটিয়া গ্রাম থেকে কষ্ট করে মেয়েকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসেন।     

রিতুর বয়স এখন ৯ বছর। ৬ মাস বয়সেই ধরা পড়ে তার থ্যালাসেমিয়া। এরপর থেকেই মেয়ের জন্য মোহাম্মদ হোসেনের চোখে ঘুম নেই। এই ৯ বছরে মেয়ের চিকিৎসার জন্য কত হাসপাতাল, ডাক্তার, কতজনের কাছে যে গেছেন তার কোনো হিসেব নেই। 

মোহাম্মদ হোসেনের ভাষায়, ‘মেয়ের যখন থ্যালাসেমিয়া রোগটি ধরা পড়ে তখন অস্থির হয়ে যাই। আমার নিজের একটি ট্রলার ছিল যা আয় হতো সেটা মেয়ের পেছনেই খরচ করি। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তার চিকিৎসা করি। ৬ মাস বয়স থেকে এই ৯ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছি। এখন আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ পর্যায়ে আছে যে বলার আর কিছুই নাই। আমার আরেকটি মেয়ে আছে নবম শ্রেণিতে পড়ে। সংসার, মেয়ের চিকিৎসা, সব কিছু চালানো আমার পক্ষে আর সম্ভব হয়ে ওঠছে না।’  

ছোট্ট রিতু শুয়ে আছে হাসপাতালের বেড়ে। ৫ দিন ধরে তার জ্বর। হাতে স্যালাইন লাগানো। ফোটা ফোটা রক্ত তার শরীরে প্রবেশ করছে আর এর মাধ্যমে পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ পাচ্ছে রিতু। একরকম নিরব হয়ে বেড়ে শুয়ে আছে। বাবার মুখটিও মলিন। পিতা মোহাম্মদ হোসেনই তাকে প্রতি মাসে রক্ত দেওয়ার জন্য এখানে নিয়ে আসে। হোসেন তার মেয়েকে নিয়ে যেমন চিন্তিত, তেমনি জীবনের কিছু ঘটনা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ভাগ্যের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছে।        

মোহাম্মদ হোসেন কিছুটা আক্ষেপ করে ইটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘‘আমি নৌকা চালাতাম। গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায়, এই রুটে আমার ট্রলার চলতো। যা আয় হতো এতে সংসার চলে যেত। এই বোটটি মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করে তৈরি করেছিলাম। বেশ ভালোভাবে সবকিছু চলছিল। একদিন টঙ্গী থেকে আমার বোটে কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ ওঠে। তারা আমাকে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলে। তাদের সঙ্গে ছোট বাচ্চাও ছিল।

কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ তারা আমার ওপর আক্রমন করে বসে। একজন মহিলা আমার বুকে পিস্তল ঠেকায়। আমি ভয় পেয়ে যাই। বুঝতে পারলাম ডাকাতের কবলে পড়ে গেছি। তারপর তারা আমাকে বসুন্ধরার কাছে এক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে ট্রলারটি নিয়ে চলে যায়। আমি অসহায়ের মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার শেষ সম্বলটুকু তারা নিয়ে যায়।’’ বললেন হোসেন।     

তিনি বলেন, ‘এরপর পরিবার নিয়ে খুব সমস্যায় পড়ে যাই। মেয়ের চিকিৎসা নিয়ে হিমসিম খেতে থাকি। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। ট্রলারটির আর কোনো হদিস পেলাম না। তারপর অনেকের সহযোগিতায় আবার ধার-দেনা করে নতুন আরেকটি নৌকা বানাই। এর মাধ্যমে পরিবার নিয়ে মোটামুটি চলে যাচ্ছিল। মেয়েটিকে তখন ঢাকার শিশু হাসপাতালে এনে নিয়মিত রক্ত দিতাম। হঠাৎ একদিন ঘাট থেকে আমার নৌকাটি চুরি হয়ে যায়। অনেক খুঁজলাম কোনো হদিস পেলাম না। এরপর আমি একেবারে অসহায় হয়ে যাই।’      

মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। ভাগ্যের কাছে বারবার হেরে যাচ্ছি। কিন্তু নিজের চেষ্টা কখনো থেমে থাকেনি। মেয়েকে নিয়ে লড়াই করছি। সেতো আমার মেয়ে আমিতো তাকে ফেলে দিতে পারিনা। বা চিকিৎসা না করে থাকতে পারিনা। 

এই পাঁচদিন ধরে তাকে নিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছি। ওর খুব জ্বর আবার রক্তও দেওয়া লাগছে। আমি মনে করি আমার মেয়ের মতো আর কারো যেন এই রোগ না হয়। আমিই শুধু জানি আমার কষ্টটা কোথায়। সেটা কেউ কখনো অনুভব করতে পারবে না।’                     

এসি