উটের খামার করে সাবলম্বী মোহাম্মদপুরের জাকের
আলী আদনান
প্রকাশিত : ০৫:৩৭ পিএম, ৩১ জুলাই ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ১২:২৭ পিএম, ১ আগস্ট ২০১৮ বুধবার
মরুভূমির প্রাণী উট। আরব্য উপন্যাসের পাতা উল্টালেই আমাদের চোখ যায় অদ্ভূত কুঁজওয়ালা প্রাণীর দিকে। সেই উট এখন বাংলাদেশে। যদিও উট চাষের জন্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুকূলে নয়, তবু সেই প্রতিকূলতাকেই এখন জয় করার পালা। দেশীয় খামারিদের কেউ কেউ প্রতিকূলতা জয়ও করেছেন। হয়েছেন সাবলম্বী। তাদেরই একজন মোহাম্মদপুরের যুবক জাকের হোসেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকায় বেশ কয়েক বছর ধরেই উটের লালনপালন হচ্ছে। সেটি বড় পরিসরে না হলেও শখের বশে লালন পালন করছেন কেউ কেউ। এদের বেশিরভাগেরই টার্গেট কোরবানি উপলক্ষে চড়া দামে উট বিক্রি। কেউ কেউ আবার উটের সুস্বাধু দুধের স্বাধ নিতেও খামার করতে আগ্রহী হয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিয়ম মেনে যত্ন নিলে বাংলাদেশেও উট লালন পালন করে লাভবান হওয়া সম্ভব।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বসিলা মোড় হয়ে বেড়ি বাঁধ দিয়ে ঢাকা উদ্যানের দিকে যেতে যে কারো চোখে পড়বে রাস্তার পাশে একটি উটের খামার। দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই খামার। স্থানীয় যুবক জাকের হোসেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালে এখানে গড়ে ওঠে এই খামার।
ভারতের রাজস্থান থেকে আনা কয়েকটি উট দিয়ে ২০০৯ সালে এই খামার গড়ে উঠে। সেখানে একটি পুরুষ ও কয়েকটি মাদী উট ছিল। এরপর বিভিন্ন সময় আরও কয়েকটি উট ক্রয় করা হয়। এসব উট পরবর্তীতে বাচ্চা প্রসব করলে এক বছরের মধ্যে এখানে উটের সংখ্যা দাঁড়ায় সাইত্রিশে।
দুই বিঘা জমির ওপর চতুর্ভুজ আকৃতিতে গড়ে তোলা হয়েছে খামারের মধ্যকার অংশ। বাঁশ ও কাঠ ব্যবহার করে উটের বাস উপযোগী খামার তৈরি করা হয়েছে। ১০ জন লোক সার্বক্ষণিকভাবে উট পরিচর্যায় ব্যস্ত। দু`জন পশু চিকিৎসক ২৯টি উটের চিকিৎসায় নিয়োজিত। জাকের হোসেনের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হয়ে আসছে খামারটি। এই খামারে উটকে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের ঘাস, খৈল, ভুসি, খড় ইত্যাদি খাওয়ানো হয়।
উদ্যোক্তা জাকের হোসেন বলেন, খামারের পরিধি বৃদ্ধি ও উটের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। ঈদুল আজহায় উট বিক্রি ও সারা বছর দুধ বিক্রিই খামারের আয়ের অন্যতম উৎস।
বিভিন্ন সময় ঈদুল আজহায় এখানকার উট বিক্রি করা হয়ে থাকে। বর্তমানে এ খামারে উটের সংখ্যা ২৯টি। উট প্রতিপালন সম্পর্কে এই প্রতিবেদককে খামারের তত্ত্বাবধায়ক তসলিমউদ্দিন বলেন, যেহেতু উট মরুভূমির প্রাণী, তাই তারা প্রথমে খামারের ভেতরে বালু ফেলে কৃত্রিম মরুভূমির আবহ তৈরি করেছি। মরুভূমির পরিবেশ দেওয়া সম্ভব না হলেও ওই আবহ তৈরির চেষ্টা করেছি। যে কারণে উটগুলো এখানে থাকতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
উটের খাবারদাবার সম্পর্কে তসলিম উদ্দিন বলেন, শুষ্ক মরু অঞ্চলের প্রাণী উটের খাদ্যাভ্যাস একেবারেই সাদামাটা। এদের খাবারের চাহিদা খুব বেশি নেই। অল্প পরিমানে খড়, ঘাস ও পানিই এদের জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট।
তসলিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি মাদী উট প্রতি ১৩ মাস অন্তর অন্তত একটি করে বাচ্চা প্রসব করে। উটের বাচ্চা ৩/৪ বছর বয়সে পরিণত হয়ে ওঠে। উট পালনের খরচও কম। গড়ে প্রতিটি উটের জন্য মাসে একহাজার করে টাকা ব্যয় হয়।
উটের মাংসের দাম বেশ চড়া। খামারি জাকেরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাপ্তবয়স্ক একটি উট জবাই করলে ১০ থেকে ১৪ মণ মাংস পাওয়া যায়। প্রতি কেজি মাংসের মূল্য ১৫০০ টাকা। দেশের বাজারে বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক একটি প্রাপ্তবয়স্ক উটের মূল্য আট থেকে দশ লাখ টাকা।
উটের দুধের বেশি চাহিদা রয়েছে এদেশে। জাকের জানান, উটের দুধ বেশ সুস্বাধু ও গাঢ়। একটি উট রোজ ১০ থেকে ১৪ লিটার দুধ দেয়। উটের দুধের দাম প্রতি লিটার ৪০০ টাকা।
খামারের স্বত্ত্বাধিকারী জাকের হোসেন বলেন, দেশে উট প্রতিপালন ও প্রজনন একটি লাভজনক প্রকল্প হতে পারে। মাংস এবং দুধ ছাড়াও উটের চামড়াও বিক্রয়যোগ্য পণ্য। উটের চামড়া টেকসই হওয়াতে এর দামও অনেক বেশি।
তিনি জানান, উট পালন অত্যন্ত লাভজনক। কারণ একটি উটের বাচ্চা লালন-পালনে মাসে ব্যয় হয় পাঁচশত টাকা। অথচ দেড় বছরের মাথায় এই উটটির বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় কমপক্ষে দেড়লাখ টাকা। এ সময়ে এর প্রতিপালন ব্যয় নয় থেকে দশ হাজার টাকার বেশি নয়।
অন্যদিকে দেড় বছর পর মা উট আরেকটি বাচ্চা দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি দুধ দেয়। প্রতি লিটার দুধের দাম ৪০০ টাকা।
উট প্রথমবার একটি বাচ্চা দেয়। দ্বিতীয়বার থেকে দুই থেকে ৩টি করে বাচ্চা দেয়। একটি উট ৫০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। এ সময় কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০টি বাচ্চা দেয়।
উটের প্রতিপালন সম্পর্কে খামারের তত্ত্বাবধায়ক তসলিম উদ্দিন জানান, নোংড়া পরিবেশ উটের প্রধান শত্রু। মল মূত্র, পানি জমে থাকা, মশা মাছি উট সহ্য করতে পারে না। তাই কৃত্রিম মরুভূমি তৈরি করতে হবে। একটি উটের জন্য কমপক্ষে দশ বর্গফুট জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।
উটের রোগবালাই সম্পর্কে তসলিম উদ্দিন বলেন, সাধারণত উটের চর্মরোগ ও জ্বর হয়। সাধারণ চিকিৎসায় তা ভালো করা সম্ভব। উটের প্রধান শত্রু কৃমি। ছয় মাস পরপর ভ্যাকসিন দিলে কৃমি দমন করা হয়।
তিনি জানান, একটি উট যেকোনো রোগ অথবা বার্ধক্যজনিত কারণে আক্রান্ত হলেও অসুস্থ অবস্থায় কমপক্ষে দু`মাস বেঁচে থেকে। এ সময়ের মধ্যে এটিকে সারিয়ে তোলা বা জবাই করে মাংস বিক্রি করা যায়। ফলে রোগ-বালাই সত্ত্বেও উট পালনে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার কোনো ঝুঁকি থাকে না।
প্রাণিবিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্যমতে, উটের মাংস ও দুধে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি যেমন- ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, নানা সংক্রমণ, পেটের আলসার, হাঁপানি, জন্ডিস, পাইলস, রক্তশূন্যতা, চর্মরোগসহ প্রায় ২০ ধরনের জটিল রোগ নিরাময় সম্ভব।
জাকের হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এদেশে উট পালনের প্রধান শর্ত হলো নিবিড় পরিচর্যা। সেটি নিশ্চিত করা গেছে বাংলাদেশেও উট পালন করে লাভবান হওয়া সম্ভব।
জাকের হোসেন আরও জানান, সরকার যদি আগ্রহী উদ্যোক্তাদের উটের প্রতিপালন ও প্রজননের ব্যাপারে সহযোগিতা করে, তবে উটের খামারও কর্মসংস্থানের একটি বিশাল ক্ষেত্র হতে পারে বলে মনে করেন এই উট খামারি।
অবশ্য জাকের হোসেনই দেশের মাটিতে প্রথম উট চাষ করছেন এমন নয়। এর আগে রাজধানীর কমলাপুর বাজার রোডে দেওয়ানবাগী ১ টি পুরুষ উট ও নয়টি মাদি উট দিয়ে উটের অানুষ্ঠানিক চাষ শুরু করেন। সেই খামারের দুধ উৎপাদন ও পরিবেশনের জন্য ইতোমধ্যে সেখানে `সম্রাট মিল্ক প্রোডাক্টস` নামে একটি প্রতিষ্ঠাণ কাজ করছে। বর্তমানে সেই খামারে ৪৫ টি উট রয়েছে। জানা যায়, প্রতিবছর বেশ কিছু উট তারা কোরবানীর ঈদে বাজারে বিক্রি করা হয়।
আ আ / এআর