প্রধানমন্ত্রিত্বে ইমরান
পাকিস্তানের ভারত-নীতি কোন পথে?
প্রকাশিত : ০৩:৪৮ পিএম, ১ আগস্ট ২০১৮ বুধবার
আগামী ১১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসিবে শপথ গ্রহণ করবেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ এর প্রধান ইমরান খান। তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে ইমরানকে। এ সময়ে দিল্লীর সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। ভারত-পাকিস্তান নীতি কোন দিকে মোড় নেবে তা নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ইমরান খানের তেহেরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) ২৫শে জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শিরোপা পেলেও, সরকার গড়ার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা তাদের নেই৷ তাই তাঁকে ছোট ছোট দল এনং নির্দলীয়দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোট সরকার গড়তে হচ্ছে৷ এই জোটসঙ্গি বাছাইয়ের কাজেও সেনাবাহিনীর একটা সবুজ সংকেতের প্রয়োজন হচ্ছে৷ আর প্রশ্নটা এখানেই৷ পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, দেশটিতে কোনো সরকারই সেনা কর্তৃপক্ষের ছত্রছায়ায় না থাকলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না৷ ইমরান খানের সরকারকেও সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল হয়ে থাকতে হবে – এমনটাই ধারণা ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের৷ তাই ইমরানের ভারত-নীতি কোনদিকে মোড় নিতে পারে, তাই নিয়ে দিল্লির কূটনৈতিক অন্দর মহলে চলছে নানা জল্পনা৷ ভারতের বিভিন্ন মিডিয়ার বেশিরভাগ বিশ্লেষক মনে করছেন, নতুন কিছু হবার নয়৷ ইমরানের জয়কে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাঁর নৈকট্যের জয় বলে মনে করছেন তাঁরা৷ এক কথায়, নতুন বোতলে পুরানো মদের বেশি কিছু নয়৷ কাজেই পাকিস্তানের ভারত-নীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখছেন না তাঁরা৷
ইমরান খানের ইতিবাচক বার্তা
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, ইমরান খানের প্রাক-নির্বাচনি এবং নির্বাচন পরবর্তী ভাষণে ভারতের সঙ্গে একটা আপোষের সুর ছিল৷ একটা ইতিবাচক বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি৷ কী বলেছিলেন তিনি? বলা বাহুল্য, কাশ্মীর দু`দেশের মধ্যে সবথেকে বড় সমস্যা৷ তাই সেই সমস্যার সমাধানে ভারত এক পা বাড়ালে ইমরান খান দু`পা বাড়াতে রাজি৷ ভারতীয় নেতৃত্ব তৈরি থাকলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতেও তৈরি তিনি৷ তবে নরমে গরমে ইমরান খান ভারতকে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, গত ৩০ বছর ধরে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এবং হচ্ছে৷ সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই আসামির কাঠগোড়ায় তোলা হচ্ছে পাকিস্তানকে৷ এটার সুরাহা করতে ভারত-পাক নেতৃত্বের উচিত আলোচনার টেবিলে বসা৷ খোলাখুলি আলোচনা করা৷ কিন্তু কথা হচ্ছে বিড়ালের গলায় প্রথমে ঘণ্টা বাঁধবে কে?
ইমরান খানকে মোদীর ইঙ্গিতবাহী শুভেচ্ছা বার্তা
ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য জোট সরকার গঠন যখন পাকা হতে চলেছে, তখনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইমরান খানকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়ে ইসলামাবাদকে শান্তি প্রতিষ্ঠার বার্তা দিয়েছেন৷ এমনকি মোদী ফোনেও কথা বলেন ইমরানের সঙ্গে৷ ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরসূত্রে বলা হয় এ কথা৷
ইমরানের প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নিতে পারেএবং ইমরানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মোদীর উপস্থিতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী হবার পেছনে পাক সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদত আছে৷ পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনা বাহিনী এবং আইএসআই একটা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা৷ ফলে এদের ভূমিকা কী হবে বা ভবিষ্যতে এরা কী ভূমিকা পালন করবে, তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে৷``
ইমরান নিজের জয়লাভ আঁচ করে য়েসব কথাবার্তা বলেছেন, তা রক্ষণশীল কথাবার্তা৷ ক্রিকেটার হিসেবে ভারতবাসীর মনে যে ভাবমূর্তি রয়েছে, ইমরানে তার সঙ্গে একেবারেই মানানসই নয়৷ তাঁর রক্ষণশীল কথাবার্তা মোতাবেক তিনি যদি পদক্ষেপ নেন এবং তার পেছনে যদি সামরিক বাহিনীর মদত থাকে, তাহলে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রসারিত হবে বলে উনি মনে করেন না৷ যদিও উনি বলেছেন যে, ভারত দু`পা এগোলে পাকিস্তান তিন পা এগোবেন৷ মোটকথা ইমরানকে চলতে হবে সামরিক বাহিনীকে তুষ্ঠ করে, প্রতি পদক্ষেপেই৷ সেটা ইমরান কতটা পারবেন, সেটা দেখার৷ এত আগে সেটা বলা সম্ভব নয়৷
ইমরানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মোদীকে আমন্ত্রণ জানালে একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর যাওয়াই উচিত৷ এটা একটা সৌজন্যমূলক বিষয়৷ মোদী বলেছিলেন, পাকিস্তান যদি ভারতবিরোধী সন্ত্রাসে মদত দেওয়া বন্ধ না করে, তাহলে ইসলামাবাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়৷ এটাকে মোদীর পাকিস্তান-নীতির নমনীয়তা বলে দেখাটা ঠিক হবে না৷ সেটা মোদী বলেছিলেন, রাষ্ট্রনীতির প্রেক্ষিতে৷ তাই বলে কি ভারতে পাকিস্তান হাইকমিশন নেই? কিংবা ইসলামাবাদে ভারতীয় হাইকমিশন নেই? শুধু তাই নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে আসছে ভারত৷ সেটা তো তুলে নেওয়া হয়নি৷ পরিকাঠামো উন্নয়নেও ভারত কাজ করছে পাকিস্তানে৷ দু`দেশের সম্পর্কে চড়াই উতরাই চলে আসছে চিরকাল৷ ডয়চে ভেলেকে এমনটাই বললেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়৷
নতুন দিল্লির অবস্থান হলো, কাশ্মীরে বা ভারতের অন্যত্র পাকিস্তানের মদতপুষ্ট সন্ত্রাস বন্ধ না হলে কোনো আলোচনা নয়৷ নিয়ন্ত্রণ রেখায় জঙ্গি অনুপ্রবেশ এবং ভারতীয় সেনা শিবিরে সশস্ত্র হামলা এবং শান্তি একসঙ্গে চলতে পারে না৷ ইমরানের ক্রিকেট মুখ ভারতে জনপ্রিয়৷ ইমরানের গুগলি বলের সুনাম আছে ভারতে৷ সেটা দু`দেশের সম্পর্ককে মধুর করতে পারবে কিনা সেটা সময়ই বলবে৷ সামরিক বাহিনীর মন জুগিয়ে চলতে হলে ভারত, আফগানিস্তান কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইমরান সরকার স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাঁর মধুচন্দ্রিমা টিকবে কিনা – সেই প্রশ্নটা রয়ে যায়৷ ভারত সম্পর্কে পাক সামরিক নেতৃত্বের একটা নেতিবাচক মানসিকতা বদ্ধমূল৷ অনেকের মতে, সেটাই কাশ্মীরে জঙ্গি কার্যকলাপে সমর্থন দিয়ে আসছে৷ এর জন্য পাকিস্তানকে হয়ত একঘরে হয়ে থাকতে হতে পারে, যেটা ইমরানের পক্ষে হবে একটা বড় বাধা৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পাকিস্তান বিরোধিতায় পাকিস্তানের মনে আশঙ্কার উদ্রেক করেছে যে, ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র জোগান ছাঁটাই করে ভারতকে সরবরাহ করবে বেশি৷ এছাড়া আর্থিক দিক দিয়েও আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মাধ্যমে ট্রাম্প পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াতে পারে৷
সবদিক বিবেচনা করে ইমরান যদি ভারতকে অলিভ শাখা দেখাতে চায়, তাহলে বুঝতে হবে এতে সামরিক বাহিনীর শিলমোহর আছে৷ তবে বিশ্লেষকরা প্রায় সবাই একমত যে, আগামী বছর ভারতের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল কী হয়, তা না দেখা পর্যন্ত ইমরান সরকার অপেক্ষা করবে৷ বড় কোনো পদক্ষেপ নেবে না৷প্রসঙ্গত, আগামী ১১ই আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন ইমরান খান৷
এমজে/