পোশাক রফতানি: বাংলাদেশকে টপকে যাচ্ছে ভিয়েতনাম
রিজাউল করিম
প্রকাশিত : ০৪:৫৫ পিএম, ৪ আগস্ট ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৬:৩২ পিএম, ৪ আগস্ট ২০১৮ শনিবার
আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশকে টপকে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম। বৈশ্বিক রফতানিতে বাংলাদেশের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে দেশটির বাজার দখল। ৭ বছর আগে যেখানে দেশটির রফতানি বাজারে দখল ছিল মাত্র দশমিক ৯ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় আজ সেখানে রফতানি আয়ে বাজার দখল হয়েছে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
অন্যদিকে ৭ বছর আগে বৈশ্বিক বাজারে পোশাক রফতানি আয়ে বাংলাদেশের দখল ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। আর আজ বাংলাদেশের রফতানি আয়ের বাজার বেড়ে মাত্র ৬ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
উল্লেখিত সময়ে বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারলেও ভিয়েতনামের মতো দ্রুতগতির প্রবৃদ্ধি দেখাতে পারেনি। ফলে পোশাক রফতানি আয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জন্য চরম ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে পোশাক রফতানি আয়ে তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনাম। পোশাক রফতানিতে এমন প্রবৃদ্ধি চলতে থাকলে খুব শিগগিরই দেশটি বাংলাদেশকে টপকে যাবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে বৈশ্বিক বাণিজ্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউটিও) সর্বশেষ পরিসংখ্যান।
গত ৩০ জুলাই প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিগত বছরে পোশাকের শীর্ষ ১০ রফতানিকারক দেশের আয়, বাজার অংশীদারিত্ব ও প্রবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে পোশাক রফতানির বৈশ্বিক বাজারে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অংশ বা হিস্যার হ্রাস-বৃদ্ধিও উঠে এসেছে।
এক্ষেত্রে ২০০০, ২০০৫, ২০১০ ও ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, বৈশ্বিক পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ২০০০ সালে ছিল বৈশ্বিক রফতানির ২ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা কমে হয় ২ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে ২০১০ সালে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব ৪ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়। সর্বশেষ ২০১৭ সালে বৈশ্বিক রফতানির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে।
এদিকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে বৈশ্বিক রফতানিতে নিজেদের অংশ বাড়াচ্ছে ভিয়েতনাম। ২০০০ সালে বৈশ্বিক রফতানির দশমিক ৯ শতাংশ ছিল ভিয়েতনামের দখলে। ২০০৫ সালে এ অংশ বেড়ে হয় ১ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০১০ সালে দাঁড়ায় ২ দশমিক ৯ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৭ সালে বৈশ্বিক রফতানির ৫ দশমিক ৯ শতাংশ দখলে নিয়েছে ভিয়েতনাম।
শীর্ষ ১০ রফতানিকারক দেশের মধ্যে ভারতের হিস্যাও ক্রমেই বাড়ছে। বৈশ্বিক রফতানিতে ২০০০, ২০০৫, ২০১০ ও ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের অংশ ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ১, ৩ দশমিক ২ এবং ৪ দশমিক ১ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশকে এরইমধ্যে ছাড়িয়েছে ভিয়েতনাম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আয় বেড়েছে মাত্র ২ শতাংশ। একই সময়ে ভিয়েতনামের বেড়েছে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতেরও পোশাক রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ। শীর্ষ রফতানিকারক দেশ চীনের রফতানি আয়ে কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ক্রেতা দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পোশাকের বাজার পুরোটাই দখলে নিয়ে নিচ্ছে ভিয়েতনাম। কারণ দেশটিতে চীন, জাপান ও কোরিয়ার অনেক বিনিয়োগকারী আছেন। দেশটির কারখানাগুলোয় উন্নত প্রযুক্তির মেশিন আছে, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতাও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। চীন ও ভিয়েতনামের সীমান্ত এক। সহজেই কাঁচামাল সংগ্রহ করতে পারে তারা। বাংলাদেশের চেয়ে লিড টাইম অনেক কম।
তিনি আরও বলেন, শুধু ভিয়েতনাম নয়, আমাদের কঠিন প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতও। ভারত এখন রাজ্যভেদে পোশাক রফতানিকারকদের বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছে। ভারতের গুজরাটের মতো রাজ্যে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ হয়, কোনো সুবিধা দিতে হয় না। অন্যদিকে আমাদের এখানে অনেক সুবিধা দিতে হচ্ছে। আবার সামনে মজুরি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ অবস্থায় পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখা সংশয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টারর্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডব্লিউটিও’র পরিসংখ্যান যা বলছে বাস্তবতায় বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অবস্থা আরও নাজুক। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২ বছরের মধ্যে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে টপকে যাবে। এর কারণ হিসেবে প্রতিযোগী ওই দেশটিকে তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই-ভিয়েতনামে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বেশি। তারা শ্রমিকদের স্কুল পর্যায় থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়। বাংলাদেশের শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা কম। শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার পর তাদের শিখিয়ে নিতে হয় বা ট্রেনিং দিতে হয়। পুরো ভিয়েতনাম জুড়ে একটি মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন আছে। যার প্রধান নেতা আবার গার্মেন্টস কারখানার ম্যানেজার। ফলে সেখানে ঘন ঘন আন্দোলন হয় না। পরিবেশ স্থিতিশীল থাকে এবং উৎপাদন ব্যহত হয় না। আর আমাদের দেশে বহু সংখ্যক ট্রেড ইউনিয়ন। একটু কিছু হলেই রাস্তায় নামে, আন্দোলন করে। ফলে উৎপাদন ব্যহত হয়। এতে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি এবং ভিয়েতনাম এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, ভিয়েতনামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভারতও এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ গত বছর ভারত সরকার গুজরাট রাজ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তাদের রফাতিন আয় ৩০ বিলিয়ন ডলারে নিতে হবে। তার জন্য যা যা করণীয় তা ভারত করবে। সেখানে রফতানি মূল্যের উপর সরাসরি ৯ শতাংশ ইনসেনটিভ দেওয়া হচ্ছে। আর আমাদের বাংলাদেশে দেওয়া হচ্ছে হয়রানি। সামান্য যে ইনসেনটিভ পায় তা হয়রানির কারণে আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
হাতেম আলী আরো বলেন, বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে পোশাক শিল্প খাতে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট রয়েছে। ফলে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। দীর্ঘ দিনের অবকাঠামো সংকট কাটিয়ে উঠতে পারিনি। ভিয়েতনাম ও ভারতের চেয়ে আমাদের ব্যাংক ঋণের সুদ হার অনেক বেশি। আমরা এখনও সাড়ে ১১ শতাংশ হারে সুদ গুণছি। এছাড়া বন্দর সমস্যাও দিনেদিনে প্রকট হচ্ছে। এসব কারণে আমরা পিছিয়ে পড়ছি-ভিয়েতনাম এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে ভিয়েতনাম পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে টপকে যাওয়ার জন্য গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বললেন অন্য কথা। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ, অবকাঠামো বা শ্রমিকদের বর্ধিত বেতন এগুলো কোন সমস্যা না। সমস্যা হলো শ্রমিকের দক্ষতা। ভিয়েতনামে শ্রমিকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। সেখানে শ্রমিকের বেতন থেকে শুরু করে সব পাওনাগুলো অত্যন্ত শৃঙ্খলভাব পরিশোধ করা হয়। সেখানে ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে আন্দোলন করে বেতন আদায় করতে হয় না। সব কথার মূল কথা হলো- কারখানার কর্মপরিবেশ ঠিক রাখলে, শ্রমিকের পাওনা ঠিক মতো দিলে, তাদের প্রশিক্ষিত করে তুললে এবং রানা প্লাজা দুর্ঘটনার দুরনাম ঘোচাতে পারলেই বাংলাদেশ রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, ভিয়েতনামের পোশাক শিল্পে প্রতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠেছে। সেখানে কারখানার পরিবেশ ভালো। সেখানে মালিকে একচেটিয়া উচ্চ মুনাফার মানসিকতা নেই। অধিকার আদায়ে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে হয় না। মন-মানসিকতা ঠিক রেখে শ্রমিকরা কাজ করতে পারে। শ্রমিকের মন ভালো থাকলে উৎপাদন বাড়ে। যার প্রভাবে দেশটি রফতানিও বাড়ছে। বাংলাদেশকেও শ্রমিকের পাওনা দিয়ে শিল্পের পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিকি করণে জোর দিতে হবে। তবেই উৎপাদন বাড়বে ও রফতানিও বাড়বে।
/ এআর /