মানব সভ্যতায় যোগাযোগের ইতিহাস ও আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি
গোলাম সারোয়ার
প্রকাশিত : ০৭:৫১ পিএম, ১৮ আগস্ট ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০৯:৩৪ এএম, ২৭ আগস্ট ২০১৮ সোমবার
আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে। আর আমাদের মতো মানুষ এসেছে যে প্রজাতি থেকে সেই হোমিনিডদের উদ্ভব হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৭০ লাখ বছর আগে। হোমিনিড প্রজাতি থেকেই উৎপত্তি হয় আধুনিক মানুষদের, যাদেরকে বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন হোমো সেপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানুষ। আর এই আধুনিক মানুষদের আবির্ভাব হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে।
শুরু থেকেই মানুষকে বেঁচে থাকার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। বাঁচার জন্যে তারা দলবদ্ধভাবে বাস করতো। ভাবের আদান প্রদানে এবং প্রয়োজনে যোগাযোগের প্রচেষ্টা মানুষের শুরু থেকেই ছিল। মানুষ সংকটে, সংগ্রামে, দুর্যোগে, লড়াইয়ে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতো সংকেতে ইংগিতে, কখনো বিচিত্র শব্দ করে, কখনো বিচিত্র চিত্র এঁকে। ধীরে ধীরে যখন তারা সভ্য হতে থাকলো, আবিষ্কার করতে থাকলো এক একটি প্রকৃতি কানুন সুবিধা। তখন দূরে অবস্থানকারী কোন স্বজনের কাছে সংকেত পাঠাতে তারা বিভিন্ন বিচিত্র নিয়ম শিখলো। কখনো ধোঁয়ার সাহায্যে, কখনো ঢোল বাজিয়ে বিপদের কথা জানান দিতে থাকলো তারা।
আমরা এখন যে জীবন যাপন করছি সে জীবনে আসতে আমাদের এক মহাকাল সময় লেগেছিল। মানব জাতির ইতিহাসে প্রথম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকার উর্বর ভূমিতে আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে। এটিই মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতা। এই সময়ের ভিতরে মানুষ সভ্য জীবন যাপন করতে শিখে যায়। কিন্তু যোগাযোগে আমরা গত ২০০ বছরেই এগিয়েছি মহাকালের সিংহভাগ। আজ পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে ইচ্ছা করলে আমরা যোগাযোগ করতে পারি, কথা শুনতে ও শোনাতে পারি এবং দেখতে ও দেখাতে পারি নিজেকে এবং প্রতিবেশীকে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে মানুষ শেখে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে। এই সময় থেকেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৭৯২ সালে ক্লদ শাপে নামের একজন ফরাসি প্রকৌশলী একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যার সাহায্যের প্যারিস ও লিলের মাঝে সংযোগ স্থাপন করা গেলো। ইতিহাসে এটিই প্রথম টেলিগ্রাফ যন্ত্র। ১৭৯৪ সালে সুইডেনের আরেক প্রকৌশলী আরেকটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্টকহোম থেকে ড্রটিংহোম পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করেন। তার নাম আব্রাহাম এডেল ক্রান্টজ। দেখা গেলো তার এই যন্ত্রের যোগাযোগ গতি, ক্লদ শাপের ওই যন্ত্র থেকে আরও অনেক বেশি।
প্রথম বাণিজ্যিকভাবে টেলিগ্রাফ যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। এর ব্যবহার শুরু হয় গ্রেট ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে মাত্র ২১ কিলোমিটার দূরত্বে যোগাযোগ করার জন্যে। এটি তৈরি করেন স্যার চার্লস হুইটস্টোন ও স্যার উইলিয়াম ফদারগিল কুকু। তারপর স্যামুয়েল মোর্স এবং আলফ্রেড ভেইল নামের দু’জন বিজ্ঞানী যে যোগাযোগ যন্ত্রটি আবিষ্কার করলেন তা’ ১৮৪৪ সাল নাগাদ ওয়াশিংটন ও বাল্টিমোরের মাঝে ৬৪ কিলোমিটার দূরত্বে কাজ করতে সক্ষম হলো। ১৮৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ২০,০০০ মাইল দীর্ঘ টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন করলো আর ১৮৬৬ সালে প্রথম আটলান্টিকের দু’পারের মাঝে যোগাযোগ স্থাপন করা গেলো। টেলিগ্রাফের এই যে এতো উন্নতি হইতেছিল, এই সময়েও কিন্তু প্রজ্ঞাবান মানুষেরা বসে রইলেন না। তারা যোগাযোগের অন্যপন্থা নিয়ে গবেষণাতে আকণ্ঠ ডুবে রইলেন।
১৮৫৭ সালে ভারত বর্ষে সিপাহিবিপ্লবে আমরা যে সময় মুক্তির জন্যে জেগে উঠতে চেষ্টা করতেছি সে সময় দুনিয়ার আরেক প্রান্তে আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল আবিষ্কার করে ফেললেন টেলিফোন। ১৮৭৮ থেকে ১৮৭৯ সালের ভিতরেই আটলান্টিকের উভয় পারে নিউ হ্যাভেন ও লন্ডন শহরে বাণ্যিজভাবে টেলিফোন ব্যবস্থা চালু হয়ে গেলো। তারপর এগিয়ে যাওয়ার সময়।
এদিকে জেমস লিন্ডে নামের একজন বিজ্ঞানী ১৮৫৪ সালে দুই মাইল দূরত্বে তারবিহীন যোগাযোগ স্থাপন করে আরেক বিস্ময় লাগিয়ে দেন। ১৯০১ সালে গুগলিয়েলমো মার্কনি যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মাঝে বেতার সংযোগ স্থাপন করে পুরো পৃথিবীকেই তাক লাগিয়ে দেন। এই জন্যে তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯০৯ সালে। বিশ্বের বিজ্ঞানীরা বেতারেই কিন্তু বসে রইলেন না। ১৯২৫ সালে জন লগি বেয়ার্ড লন্ডনের সেলফ্রিজ নামের একটি মনিহারী দোকানে প্রথম চলন্ত ছবি প্রেরণ করে দেখান। এই যন্ত্রের ওপর নির্ভর করেই ১৯২৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু করে ব্রিটিস ব্রডকাস্টিং করপোরেশন বা বিবিসি। অন্যদিকে ১৮৩৩ সালে চার্লস ব্যাবেজ আবিষ্কার করেন কম্পিউটার যা উন্নত হতে হতে ১৯৮১ সালে আইবিএম কোম্পানির পার্সোনাল কম্পিউটার বাজারে আসার পরে বিশ্বের উন্নয়ন, উৎপাদন আর উদ্ভাবনে আসে আমূল পরিবর্তন। তারপর গত শতাব্দীর নব্বই দশকের পর ইন্টারনেট বিশ্বকে দেয় মহাজাগতিক গতি। সেই গতিই পৃথিবীতে এনে দিচ্ছে প্রগতি। এখন আর মানুষকে উপকথা বলে, পুরাণের আগমের কথা বলে ভুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। এখন মানুষ পুরো পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের সত্যকে যাচাই করতে পারে মিনিটে মিনিটে।
আর তাই বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত ক্ষেত্র হলো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থেকে এই জগতে এই সময়ে টিকে থাকা যাবে না। ইন্টারনেট আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ঐন্দ্রজালিকতার বর্তমান পৃথিবীতে সবচেয়ে দরকারী পুঁজি হলো আইডিয়া বা ধারণা। শুধু আইডিয়া সেল করেই আজকের পুরো পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছে আইডিয়াগুলো। অর্থনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছে আইডিয়াগুলো। সত্য হলো বিশ্বে এখন আইডিয়ার চাঞ্চল্য চলছে। আইডিয়ার পৃথিবীতে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দোকানের কোন মালামাল নেই, যেমন আলিবাবা। সবচেয়ে বড় গাড়ি সেবা কোম্পানির কোন গাড়ি নেই, যেমন উবার। সবচেয়ে বড় হোটেল কোম্পানির কোন হোটেল নেই, যেমন এয়ারবিএনবি। আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিড়িয়া কোম্পানির কোনো উপাদান নেই, যেমন ফেসবুক। এখনকার আসল সম্পদই হলো মেধাসম্পদ। আজকের বিশ্বে মাত্র ৫৫ জনেও এমন একটি কোম্পানি বানাতে পারে যা বাজারে বিক্রি হয় প্রায় এক হাজার নয়শো কোটি ডলারে, যেমন হোয়াটসঅ্যাপ।
তাই আধুনিক পৃথিবীতে রাষ্ট্রগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হলে তার আগামীর সন্তানদেরকে তথ্য প্রযুক্তিতে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে আগামী প্রজন্মের জন্যে তথ্যপ্রযুক্তির সব অবকাঠামো পরিকাঠামো সৃষ্টি করে রাখতে হবে। ব্যক্তি জীবনে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী নাগরিক গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান পৃথিবী একটি একক ভিলেজ। এখন কোন এক পাড়া গাঁয়ে তৈরি পণ্যও বিশ্বের নামীদামী সুপারসপে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। পৃথিবীর যেকোন কোম্পানির যেকোন কাজ যেকেউ ঘরে বসেই করে দিয়ে আয় করতে পারে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের প্রযুক্তিবিদদের তৈরি সফটওয়্যার ত্রিশটির বেশি দেশে রফতানি করা হয়ে গেছে। এখন অনলাইনে ঘরে বসেই যে কোনো পণ্য কেনাবেচা করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির নিবন্ধন, ফরম সংগ্রহ ও ফলাফল প্রকাশ, বিদেশে চাকরির এবং হজের নিবন্ধন, আয়কর রিটার্ন দাখিল, দরপত্রে অংশগ্রহণ, টেলিমেডিসিন, তথ্য সংগ্রহসহ যাবতীয় কাজে অনলাইন এনেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই সময়ে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দুর্নীতিমুক্ত, সময় ও অর্থ সাশ্রয়ী, আধুনিক ও গতিশীল সমাজব্যবস্থা বির্নিমাণে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এনেছে আরেক নতুন যুগ। এই প্রযুক্তির সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রে ও সমাজে পর্যবেক্ষণ ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি একক সোস্যাল সিকিউরিটি নাম্বার ব্যবহার করা হয়। অত্যন্ত ব্যক্তিগত রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ওই নাম্বারে থাকে ব্যক্তির সকল তথ্য যেমন, ট্যাক্স ফাইল, বাড়ি, গাড়ি, স্কুল কলেজ, চাকরি, ব্যাংক একাউন্ট, ইনস্যুরেন্স , গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পুলিশ রিপোর্ট, কোর্ট, কাচারি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বাড়ি ভাড়াসহ যাবতীয় তথ্য। এটি যদি আমাদের দেশেও নিশ্চিত করা যায় তবে সমাজের অস্থিরতা দূর হবে। মানুষ শান্তিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারবে। রাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে দুদক, আদালত, পুলিশ বিভাগ, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, ক্রেডিট ব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলো এটি থেকে সহজেই তথ্য পেতে পারেন। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রটির নাম্বারেই ওইসব তথ্যের সমাবেশ করা যায়। এতে করে রাষ্ট্রে দুর্বৃত্তায়ন দূর হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের মতে, পৃথিবীতে প্রতিবছর চার কোটি ২০ লাখ বেকার বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতিবছর কর্মবাজারে প্রবেশ করে প্রায় ২২ লাখ তরুণ। এদের মধ্যে দেশে বিদেশে ১২ লাখের মতো কর্মবাজারে জায়গা করে নিতে পারে। কিন্তু প্রায় ১০ লাখ তরুণের প্রতিবছর কর্মসংস্থান হয় না। এটি অবশ্যই আমাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের ছোট দেশ, ভূমি যৎসামান্য এবং অপ্রতুল, সেজন্যে প্রথাগত এবং ঐতিহ্যিক ততটা কর্মসৃজন আমাদের পক্ষে কঠিন। কিন্তু আমাদের সামনে অবারিত সুযোগ আছে বৈশ্বিক কর্মবাজারে প্রবেশ করার। ইন্টারনেটভিত্তিক দক্ষ একটি প্রজন্মই পারবে ওইসব বাজারে নিজেদের জায়গা করে নিতে। সেজন্যে তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র। তাছাড়া প্রযুক্তিতে বিশ্ব এখন যেখানে পৌঁছেছে সেখানেই অনন্তকাল বসে থাকবে না। তাই রাষ্ট্রকে এই ব্যাপারে অবিরাম গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার করতে হলে আমাদের একটি ব্যাপক প্রযুক্তি নীতিমালা লাগবে, বাজেটে তার প্রতিফলন লাগবে। তাহলেই আগামীর পৃথিবীতে টিকে থাকা যাবে।
লেখক: গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এসএইচ/