ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৬ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

সেলিম আল দীন: বাংলা নাটকের পথিকৃৎ

লুৎফুল কবির রনি

প্রকাশিত : ০৬:০৪ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৬:০৬ পিএম, ১৯ আগস্ট ২০১৮ রবিবার

‘আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে বাংলা কবিতার চেয়ে নাটকের যে দীনতা, উপন্যাসের চেয়ে নাটকের যে সীমাবদ্ধতা সেটাকে ঘোচাতে হবে। সেটা ঘোচাতে যদি যাই তাহলে আমাকে নতুন ভূমি, নতুন মানুষ, নতুন শিল্প দর্শন আবিষ্কার করতে হবে। এই ভূমি আবিষ্কার করতে গিয়ে আমার কাছে প্রচলিত কাঠামোগুলোকে কঠোরভাবে বর্জন করতে হয়েছে। ফলে আমার লেখা পড়ে হুট করে নাটক মনে হয় না। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, মূলত আমি নাটকই লিখতে চেয়েছি।’ - সেলিম আল দীন

বাঙালির ভালোবাসায় পরিপ্লুত পুষ্পিত এক নাম সেলিম আল দীন। তাকে বলা হয় বাংলা নাটকের গৌড়জন। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু রেখে গেছেন তার অবিনশ্বর মহাকাব্যিক সব সৃষ্টি সম্ভার। তার নাটকই বাংলা থিয়েটারের বহুযুগের প্রতীক্ষার অবসান ঘটায়।

বাংলার মাটিতে, বাংলার জলহাওয়ায় বাংলার প্রাণের ভাষাতেই জন্ম নেয়া তার নাটকগুলো বাংলা নাটকের সব উপাদানকে ছুঁয়ে যায় আধুনিকের মন নিয়ে। এ কারণেই বাঙালির কাছে সেলিম আল দীন এক অবিস্মৃত নাম। বাংলা নাটকের নিজস্ব স্বর, রীতি বা কৌশলজাত যে ধারা হাজার বছর ধরে আমরা প্রজন্মপরম্পরায় বহন করে চলেছি, তা নিজের ভাবনার দূরবীনে দৃষ্টিপাত করে যিনি শীর্ষস্থানটি নিজের করে নিয়েছেন, তিনি হলেন আমাদের গৌড়জন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। বাংলা নাটকের স্বতন্ত্র কারিগর।

তিনি মানুষের পথে হাঁটতে দুর্দান্ত পছন্দ করতেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়নাভিরাম সবুজ ক্যাম্পাসে শিল্পশিষ্যদের সঙ্গে হাঁটাপথেই মানুষের কথা, জীবনের কথা, দেশের কথা, ভূমির কথা ভাবতেন আর গল্প বুনতেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের এই প্রবাদপুরুষ। শুধু নাট্যকারই নন, তিনি একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, সংগঠক, নাট্যনির্দেশক এবং শিল্পতাত্ত্বিক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রতিষ্ঠা সেলিম আল দীনের হাত ধরেই।

ঢাকা থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সেলিম আল দীন ১৯৮১-৮২ সালে নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফকে সাথি করে গড়ে তোলেন গ্রাম থিয়েটার। তাঁর প্রথম রেডিও নাটক ‘বিপরীত তমসায়’ ১৯৬৯ সালে এবং টেলিভিশন নাটক আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘লিব্রিয়াম’ (পরিবর্তিত নাম ‘ঘুম নেই’) প্রচারিত হয় ১৯৭০ সালে। সেলিম আল দীনের প্রথম দিককার নাটকের মধ্যে সর্পবিষয়ক গল্প, জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন, মূল সমস্যা—এগুলোর নাম ঘুরেফিরে আসে।

সেই সঙ্গে প্রাচ্য, কিত্তনখোলা, বাসন, আততায়ী, সয়ফুল মূলক বদিউজ্জামান, কেরামত মঙ্গল, হাত হদাই, যৈবতী কন্যার মন, মুনতাসির ফ্যান্টাসি ও চাকা তাঁকে ব্যতিক্রমধর্মী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। জীবনের শেষ ভাগে ‘নিমজ্জন’ নামে মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান বেরিয়ে আসে সেলিম আল দীনের কলম থেকে। এ ছাড়া তাঁর নাটক নিয়ে চলচ্চিত্র চাকা বা কিত্তনখোলা ব্যতিক্রমী শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃত। মহুয়া, দেওয়ানা মদিনা, একটি মারমা রূপকথা, কাঁদো নদী কাঁদো, মেঘনাদ বধ, ম্যাকবেথসহ বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী নাট্য নির্দেশনা দেন তিনি।

সেলিম আল দীন তাঁর সামগ্রিক নাট্যকর্মেও স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, কথক সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ২০০৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। সেলিম আল দীন বাংলার নদী, জল, বায়ু, পাখপাখালি আর জোছনাসমেত প্রকৃতিকে মাখামাখি করে বেড়ে উঠেছেন। তাই ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল ভেঙে বাংলা তথা প্রাচ্য গল্প ভাবনায় বুঁদ ছিলেন তিনি। সহজাতভাবেই প্রাচ্যপুরাণ কথা আত্মস্থ করে ঐতিহ্যের ধারায় সমকালীন বাংলা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিক খুঁজে ফেরার প্রয়াসী হন সেলিম আল দীন।

আমাদের হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি-বিনাশী এমন ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা, গ্লানি বা হীনমন্যতা ছুঁড়ে ফেলে সেলিম আল দীন হেঁটেছিলেন আবহমান বাংলার পথে। চিরচেনা তবে অনাবিষ্কৃত সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে তিনি তাঁর গল্পগাঁথায় এক মহাকাব্যিক দ্যোতনায় নিরন্তর নিরীক্ষা ও গবেষণার পথ বেয়ে বাঙালির নিজস্ব নাট্যকাঠামো দাঁড় করিয়ে গেছেন। খণ্ড খণ্ড ঘটনার বিন্যাসে, কাহিনী, উপকাহিনীর উপজীব্যতায় এক গীতল উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে তাঁর নাট্য আখ্যান পূর্ণতা পায়। সেখানে গল্প-উপন্যাস, সংগীতের ঐকতানিক মূর্ছনা। এর মধ্য দিয়েই সেলিম আল দীন প্রবেশ করেছেন তাঁর নিজস্ব ভাবধারার বাঙালিয়ানার আপন ভূমিতে।

বাঙালির চিরায়ত নিজস্ব রুচিবোধ ও শিল্পরীতিতে গড়া এই নাট্য আঙ্গিককে সেলিম আল দীন নিজেই নামকরণ করেছেন বর্ণনাত্মক রীতি শিরোনামে। এই নাটকের কাঠামোকে তিনি বলেছেন ‘কথানাট্য’। নব্বইয়ের গণআন্দোলনকালে ‘চাকা’ নাটক রচনার সময় বাংলাদেশে ছিল সামরিক বুটের প্রচণ্ড দাপট। বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে নূর হোসেনরা রক্ত দিচ্ছেন। সে সময় বিভিন্ন স্থানে ছাত্র, পেশাজীবীসহ অনেক অজ্ঞাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের হাত।

নাট্যকার এই অজ্ঞাত মানুষকে পৌঁছে দিতে চান জ্ঞাত ঠিকানায়। কিন্তু পথ চলতে চলতে দেখা যায়, সেই মরদেহগুলোই মানুষের বুকে স্বজন হারানোর বেদনা জাগিয়ে তোলে। পাঠক-দর্শককে নাট্যকার স্মরণ করিয়ে দেন, রাষ্ট্র যখন বিশেষ বাহিনীর হাতে পরিচালিত, সে সময় সাধারণ মৃত্যুর উৎসবেই জীবনের মানে খোঁজা আর মৃত্যুর মিছিলেই মুক্তির সন্ধান লাভের কথা। রাষ্ট্র নিয়ে সেলিম আল দীনের সেই উপলব্ধি সমকালেও বড় প্রাসঙ্গিক। ‘রাষ্ট্রের দেহ আছে। মনুষ্যদিগেরও আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের দেহ ছেদবিচ্ছেদে নিত্যই পূর্ণ। যেমন ছোটোকালে পারদ দেখিয়াছিলাম আধুলির সমান।

তা কচুপাতায় রাখিলে অখন্ড আবার কচুপাতা হইতে ঝরিয়া পড়িলে অনতিবিলম্বে বহুসংখ্যক রূপালি বিন্দুতে পরিণত হইয়া বিচ্ছিন্নভাবে সম্পূর্ণতা লাভ করে। রাষ্ট্র সেইরূপ।’ ‘তোমার সম্মুখে অনন্ত মুক্তির অনিমেষ ছায়াপথ’ ‘গঠিত হই শূন্যে মিলাই’— এমন দার্শনিক কথার কারিগর, নবজন্মের পিতৃপুরুষ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের আজ জন্মদিন। এই শিল্পতাত্ত্বিকের প্রতি মাথা নত শ্রদ্ধাঞ্জলি!

লেখক: সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী

অা অা// এআর