এন্টারটেইনার অ্যওয়ার্ড: সেরা সাংস্কৃতিক সংগঠক কানাই চক্রবর্ত্তী
প্রকাশিত : ০৮:১৩ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০১৮ শনিবার
চট্টগ্রাম মিডিয়া ক্লাব এন্টারটেইনমেন্ট এর ‘এন্টারটেইনার অ্যাওয়ার্ড ২০১৮’ এর সেরা সাংস্কৃতিক সংগঠক ও নাট্যকার হিসেবে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর উপ-প্রধান প্রতিবেদক কানাই চক্রবর্ত্তী মনোনীত হয়েছেন। সন্দ্বীপে সংস্কৃতি বিকাশে তাঁর কর্মের এই অনন্য অবদানের জন্য এ পুরস্কার পাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় ১৯৬২ সালের ২৯ মে কানাই চক্রবর্ত্তী জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শিব শংকর চক্রবর্ত্তী এবং মা বাণী চক্রবর্ত্তী। বাবা ছিলেন শিক্ষক এবং একাধারে সাংস্কৃতিক ও নাট্য ব্যক্তিত্ব।সন্দ্বীপে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের পথিকৃত এই শিক্ষক বাবার হাত ধরে এবং অনুপ্রেরণায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি নাটকের সাথে যুক্ত হয়ে পরেন। একইভাবে কিশোর বয়সেই অনুরক্ত হন প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতি।
ছোটবেলা থেকে সংস্কৃতি এবং নাটকের প্রতি তীব্র অনুরাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭৯ সালে সন্দ্বীপে প্রথম সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব’ গঠনের মধ্য দিয়ে। সে সময় জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র পাঠকরাই সারাদেশে যে ফোরাম ক্লাব গঠন করেন। আর সন্দ্বীপে এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।
জন্মের পর থেকেই সংগঠনটি সন্দ্বীপের চলমান সাংস্কৃতিক এবং নাটক মঞ্চায়নের খোল-নলচে যেভাবে পাল্টিয়ে দেয়, তাকে বলা যেতে পারে সন্দ্বীপে নাটক এবং সংস্কৃতির নতুন যুগের শুরু। এর আগে সন্দ্বীপে নাটক হতো সারারাত ধরে এবং বাজারের ছাপানো স্ক্রিপট নিয়ে। পুরুষেরা নারী সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। আরও পরে শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে বাণিজ্যিকভাবে নারী শিল্পী এবং তথাকথিত প্রিন্সেসদের অংশগ্রহণে নাটক পরিবেশন। ঢাকা থেকেও চলচ্চিত্র শিল্পী এবং প্রিন্সেস নিয়ে নাটক হয়েছে সন্দ্বীপে। তখনও সন্দ্বীপে সাংস্কৃতিক এবং নাটক ছিলো শুধুই বিনোদন।
এ রকম প্রেক্ষাপটে নাটক শুধু বিনোদন নয় বরং দেশ ও সমাজ বদলের হাতিয়ারও, পল্টন লাল দিঘীর পাড় নয়, নাটকই সাধারণ মানুষের কথা বলে, শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদ হোক নাটকের সংলাপে’ এই স্লোগান ধারণ করে নিজেদের লেখা এবং নির্দেশনায় থিয়েটার কনসেপ্ট নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিচিত্রা ফোরাম ক্লাবের। কানাই চক্রবর্ত্তীর লেখা ‘সিড়িঁ’ নাটক দিয়ে এর শুরু। প্রায় সোয়া এক ঘন্টার এ নাটকটির আঙ্গিক অনেকটাই ছিলো ঢাকার মঞ্চ নাটকের আদলে। পরবর্তী সময়ে কানাই চক্রবর্ত্তীর লেখা এবং নির্দেশনায় উল্লেখযোগ্য অন্য নাটকগুলো হলো ‘শেষ সংবাদ, সাবধান ভাইরাস আসছে, আক্কেল আলীদের ট্র্যাজেডি, চুপ তিনি আসছেন, হুজুগ আলী এবার মরবে, ঈমান আলীর অ্যাকশান, মহড়া, বজ্জাত, নূরা পাগলার শেষ কথা, আনন্দের মুক্তি চাই (কাব্য নাটক), রাজা ধপাস, টিরিকস, ক্রসবাঁধ সমাচার, অতএব বিদগ্ধ ভদ্রমহিলাগণ, দুই পন্ডিতের গল্প (রুশ গল্প অবলম্বনে) ইত্যাদি।
নিজের এবং সংগঠনের নাট্যকার ছাড়াও বিশিষ্ট নাট্যজনদের লেখা নাটকের সঙ্গে সন্দ্বীপের দর্শকদের পরিচয় করে দেয় বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব। সন্দ্বীপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন নাটক প্রথম মঞ্চে আনে এ সংগঠনটি। এর মধ্যে তাঁর লেখা ‘ডাকঘর’ এবং ‘চির কুমার সভা’ (অংশ বিশেষ) ছিল উল্লেখযোগ্য।
মমতাজ উদ্দিন আহমদের ‘স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা এবং ফলাফল নিম্নচাপ, সেলিম আল-দীনের লেখা সংবাদ কার্টুন, আকতার হুসেনের ‘চাপা পড়া মানুষ’ নিয়মিত প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চে আনে বিচিত্রা ফোরাম। বিচিত্রা ফোরামের নাটক নিয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের মুসলিম হলে আন্তঃশিশু নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। প্রতিযোগিতায় কানাই চক্রবর্ত্তীর ‘চুপ তিনি আসছেন’ নাটকটি নিয়ে ক্লাবের শিশুশিল্পীরা অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অর্জন করে। চট্টগ্রামের বৃহত্তর নাট্য দর্শকদের কাছে সন্দ্বীপের সংস্কৃতি তুলে ধরার এ মহৎ কৃতিত্বটি ছিলো কানাই চক্রবর্ত্তীর।
শুধু নাটক নয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য কর্মকান্ডেও যোগ করেছিলেন আধুনিক মাত্রা। দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, সুন্দর হাতের লেখা প্রতিযোগিতা, শিশুবর্ষ পালন ও শিশুদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন, পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারী, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, রবীন্দ্র-নজরুল, সুকান্তের জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন ছিলো নিয়মিত কর্মসূচি। গণসংগীতের প্রচলন ছিলো এ ক্লাবের অন্য একটি অর্জন।
সন্দ্বীপের আনাচে-কানাচে নাটককে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে কানাই চক্রবতী প্রতিষ্ঠা করেন শুধু নাটকের সংগঠন ‘সন্দ্বীপ থিয়েটার’। ১৯৮৯ সালের ৩০ ও ৩১ মার্চ এবং ১ এপ্রিল সন্দ্বীপ থিয়েটার প্রথম আয়োজন করে সন্দ্বীপে তিন দিনব্যাপী মূলধারার নাট্যোৎসব। সন্দ্বীপ টাউন কলাভবন মঞ্চে অনুষ্ঠিত এ উৎসবে চট্রগ্রামের দুটি নাট্যদল ‘কাল পুরুষ’ শান্তনু বিশ্বাসের লেখা এবং নির্দেশনায় ‘ইনফরমার’ এবং এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার আন্তন চেখভের ‘বিবাহ প্রস্তাব’ নাটক পরিবেশন করে।
উৎসবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইদ্রিস আলী, অধ্যাপক মহিবুবুল আজিজ, বর্তমানে প্রথম আলোর উপ-সম্পাদক ও কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী (তৎকালীন পূর্বকোণের সহকারি সম্পাদক ছিলেন)। উৎসবে ‘স্বাগতিক দল সন্দ্বীপ থিয়েটার এবং দক্ষিণ সন্দ্বীপ থিয়েটারও নাটক পরিবেশন করে। সন্দ্বীপ থিয়েটারের অন্য প্রযোজনা ছিলো শুভংকর চক্রবর্ত্তীর ‘মরা’ এবং কানাই চক্রবর্ত্তীর ‘টিরিকস’ ও ‘রাজা ধপাস’।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় শুধু সন্দ্বীপের মানুষ এবং সম্পদই নষ্ট করেনি, একইভাবে নষ্ট করে দেয় সব সুকুমার বৃত্তিও। তাই ১৯৭৯ এবং ১৯৮৯ সালে জন্ম নেওয়া বিচিত্রা ফোরাম ক্লাব এবং সন্দ্বীপ থিয়েটার ১৯৯১ সালে বিলীন হয়ে যায় কালের গর্ভে। তবে সংগঠন দুটোর কর্মকান্ড এখনও ইতিহাস হয়ে আছে সন্দ্বীপের মানুষ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে।
ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো গৌরবের এই এক দশককে সংস্কৃতি ও নাট্য আন্দোলনের জন্য সন্দ্বীপের রেঁনেসা হিসেবে একদিন বিবেচনায় আনবেন। আর এই এক দশকের সব নাট্য এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কানাই চক্রবর্ত্তী। সন্দ্বীপে না হলেও কানাই চক্রবর্ত্তী এখনও নাট্যচর্চার সাথে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি ঢাকার মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের নিয়মিত সদস্য।
তার লেখা তিনটি নাটক মহাকাল প্রযোজনা করেছে। নাটক তিনটি হলো আনন্দের মুক্তি চাই, গণদরখাস্ত এবং ‘নতুন দেশে নতুন বেশে’। এর মধ্যে ‘আনন্দের মুক্তি চাই’-এর প্রায় ষাটটি প্রদর্শনী হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে ‘দৈনিক রুপালী’তে কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে দৈনিক বাংলা বাজার, জনকন্ঠ, দৈনিক যুগান্তরসহ আরও কয়েকটি পত্রিকায় কাজ করেছেন তিনি।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন সন্দ্বীপে নাগরিক সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত থাকার পরও শুধু হৃদয়ে বাংলা সংস্কৃতি লালন ও ধারণ করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সংস্কৃতির মাধ্যমে সমাজ বদলের মহামন্ত্রে সেই ঝাঁপিয়ে সফল হয়েছিলেন বৈকি। আজও তার হাতে গড়া অসংখ্য সংস্কৃতিজন সন্দ্বীপ সন্তান বিরাজমান।
কেআই/ এমজে