ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

বাজারে ধস

ব্যবসা গুটানোর কথা ভাবছেন কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা

রিজাউল করিম

প্রকাশিত : ০৬:৫২ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৯:৪০ এএম, ২৮ আগস্ট ২০১৮ মঙ্গলবার

চামড়ার রফতানি বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব কমে যাওয়া; গত বছরের চামড়া এ বছর পর্যন্ত বিক্রি করতে না পারা ও সাভারে নতুন ট্যানারি পল্লীতে শিল্প স্থাপনে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয়সহ নানাবিধ সংকটে দেশের চামড়া শিল্প মালিকরা। খাতটির এ দুরবস্থায় বিভিন্ন কৌশলে টিকে থাকার উপায় বের করছেন চামড়া শিল্প মালিকরা। কৌশলে মালিকরা নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলে বিপাকে পড়েছেন কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা। চামড়ার যথাযথ দাম না পেয়ে নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছেন তারা।

রাজধানীর কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী পারভেজ আহম্মেদ। প্রায় এক যুগ ধরে চামড়া ব্যবসা করে আসছেন তিনি। এবারও তিনি ১৪ লাখ টাকা দিয়ে ২৪শ’পিচ গরুর চামড়া ও আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ৬ হাজার পিচ ছাগলের চামড়া কিনেছেন। তিনি এবার প্রতিটি ছাগলের চামড়া কিনেছেন ১০ থেকে ৩০ টাকা মূল্যে। আর প্রতিফুট গরুর চামড়ার দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকা পড়ে গেছে। যেগুলো এরই মধ্যে লবণ ও প্রয়োজনীয় ক্যামিকেল দিয়ে রেখেছেন তিনি। কেনার পর এখন তিনি ভাবছেন এবার চামড়ার দাম একেবারেই কম। তার উপর আবার ক্যামিকেল খরচ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আগে যেখানে প্রতিফুট চামড়ার পেছনে ক্যামিকেল খরচ হতো ১৬ টাকা। এখন সেখানে খরচ হচ্ছে ৩২ টাকা থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত।

পারভেজ আহম্মেদ বলেন, এবার চামড়ার দাম খুব কম ধার‌্য করা হয়েছে। তাতে আমাদের ব্যবসা এবার গুটিয়ে যাবে।এবার গরুর চামড়ার দাম যদি ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং ছাগলের চামড়ার দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা হলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারতাম।

কাঁচা চামড়ার দাম কমার এ দুর্গতির কথা জানালেন ফরিদপুরের ব্যবসায়ী মোঃ আমিন। পনেরো বছর ধরে কাঁচা চামড়ার ব্যবসা করছেন তিনি। কিন্তু এ বছরের মতো এতটা ক্ষতি আর আগে হয়নি তার। কেনা দাম না পাওয়ায় তিনি এখন চামড়া বিক্রি নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকরা যে রেটে দর দিয়েছেন, তাতে তো কিছু কেনাও যায় না, বিক্রিও করা যায় না। একেকটা চামড়ার দাম পড়ে পাঁচশ’ টাকা-ছয়শ’ টাকা। বড় চামড়া হলে সর্বোচ্চ একহাজার টাকা হয়। কিন্তু একজন শ্রমিকের বেতনই আছে একহাজার টাকা। তার সঙ্গে লবণ আছে, পরিবহন খরচ আছে। এতো খাটাখাটি করে আমাদেরও কিছু লাভ করতে হয়। এরপরে আর কিছু তো থাকেই না, বরং লোকসান হয়ে যাচ্ছে।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে মোটামুটি ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ গরুর চামড়া, ৩১ দশমিক ৮২ শতাংশ ছাগলের, ২ দশমিক ২৫ শতাংশ মহিষের এবং ১ দশমিক ২ শতাংশ ভেড়ার চামড়া। এর অর্ধেকের বেশি আসে কোরবানির ঈদের সময়।

কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, মূলত এবার চামড়ার বাজারে প্রতিযোগিতা নেই। যার কারণে চামড়ার দাম একেবারেই কম। ট্যানারি মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি কমে যাওয়া, সাভারে শিল্প স্থানান্তরে বিপুল অঙ্কের অর্থ আটকে পড়া ও গত বছরের চামড়া এখনও রফতানি না করতে পারার দোহাই দিয়ে চামড়ার দাম কমিয়েছেন। এসব দোহাই দিয়ে শিল্প মালিকরা কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের গত বছরের পাওনা টাকা এখনও আটকে রেখেছে। যা কোরবানির আগেই পরিশোধ করার নিয়ম। মালিকদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া বিক্রির টাকা না পেয়ে এ বছর অনেক ব্যবসায়ী চামড়া ক্রয় করতে পারেনি। ফলে চামড়ার বাজারে প্রতিযোগিতা কমে গেছে। মন্দা বাজারে কমে গেছে চামড়ার দাম।

চামড়া শিল্প মালিকদের প্রতি অভিযোগ তুলে দেলোয়ার হোসেন আরও বলেন, একদিকে টাকা না পেয়ে আমরা কাঁচা চামড়া কিনতে পারছি না। অন্যদিকে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে চামড়া শিল্প মালিকরা তলে তলে চামড়া ঠিকই ক্রয় করছেন।ফলে মন্দা বাজারে আমরা কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ট্যানারি মালিকরা ঠিকই ব্যবসা করে যাচ্ছেন।

এদিকে চামড়ার দাম কমার জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে দায়ী করছেন বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ। তিনি বলেন, কাঁচা চামড়ার দাম কমার কয়েকটি কারণ রয়েছে। চামড়ার দামের বেঞ্চ মার্ক হচ্ছে আমেরিকা। সেখানে যদি দাম কমে, তাহলে সারা বিশ্বেই দাম কমে। এ কারণে আমাদের দেশেও গত দুইবছর ধরে চামড়ার দাম কমার দিকে রয়েছে।

এছাড়া চামড়াটা আমাদের দেশ থেকে চীনের ক্রেতারা কিনে নিয়ে পণ্য বানিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করে। কিন্তু চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে আমেরিকা চীনের পণ্যের ওপর যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, সেটার প্রভাব বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের ওপর পড়েছে।

পাশাপাশি কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত দুইবছর ধরে আমাদের কাছ থেকে চামড়া কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে আমাদের দেশের চামড়ার যে চাহিদা ছিল বিদেশের বাজারে, সেই চাহিদা দিন দিন কমছে। মনে রাখাতে হবে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করা হয়। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মাত্র পৌনে তিনকোটি, বাকিটা রফতানি হয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ বিষয়ে বলেন, দেশের মানুষের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ায় পশু কোরবানির সংখ্যা বেড়েছে।কিন্তু চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থা পাল্টায়নি, আর মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও রয়েছে নানা অব্যবস্থাপনা। সেজন্য আধা-প্রক্রিয়াজাত চামড়ার যে বাজারগুলো বিশ্বে রয়েছে, সেদিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরির দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।

এছাড়া এখনও যে প্রক্রিয়ায় চামড়ার দর নির্ধারণ করা হয়, তাতে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধার বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়। এতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চামড়া সংগ্রহের কোন চেইন গড়ে ওঠে না। তাই চামড়ার মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরো সাপ্লাই চেইনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত।

চামড়ার দাম কমার কারণে কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ার কথা বললেও এবারের চামড়ার দাম নির্ধারণ সঠিক ছিল বলে দাবি করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ নিয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ জটিলতা শিগগিরই কেটে যাবে বলে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে।

রোববার সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ঈদ পরবর্তী শুভেচ্ছা বিনিময়ের ফাঁকে সাংবাদিকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিন কারণে এবার চামড়া কম বিক্রি হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, দাম কমানোর পরও বিক্রি হচ্ছে না এর কারণ হল এক নম্বর- গতবারের চামড়া রয়ে গেছে, দুই- যারা ট্যানারি মালিক, তারা বলছে ব্যাংকের ঋণ সঠিক সময়ে পায়নি, তিন- সাভারে যে কারখানাগুলো হওয়ার কথা সেগুলো গড়ে ওঠেনি।

ঈদ সামনে রেখে গত ৯ আগস্ট কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। বাণিজ্যমন্ত্রী সেদিন ঘোষণা দেন, ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়; ঢাকার বাইরে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কিনবেন। সারা দেশে খাসির চামড়া ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৩-১৫ টাকায় সংগ্রহ করবেন তারা।

/ আরকে / এআর