সন্দ্বীপের উন্নয়নে সন্দ্বীপীদের করণীয়
অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জ্জী
প্রকাশিত : ০৮:১৮ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ০৯:৩৬ এএম, ২৭ আগস্ট ২০১৮ সোমবার
অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জ্জী
সন্দ্বীপ জনপদটি ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বিচারে একটি অতি পরিচিত ভূখন্ড। এ পরিচিতির আর একটি কারণ হল সন্দ্বীপের উপর দিয়ে প্রায়শই বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণ সত্তেও সন্দ্বীপ, দেশকে উপহার দিয়েছে অনেক শিক্ষক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক, ব্যবসায়ী, সরকারী কর্মকর্তা, চিকিৎসক, শাসক ও যোদ্ধা। সন্দ্বীপের এ গুণী সক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ সন্দ্বীপের বাইরে অর্থাৎ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত-যাঁরা Dias Pora সন্দ্বীপী হিসেবে পরিচিত। সন্দ্বীপের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উন্নয়নের প্রতি Dias Pora এ জনগোষ্ঠীর আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত।
সন্দ্বীপের অর্থনীতি ও সমাজ কি অবস্থায় আছে অথবা সন্দ্বীপে অবস্থানকারী মানুষগুলো আর্থিক এবং সামাজিকভাবে কেমন আছে? প্রশ্নটির উত্তর হয়তো হবে নেতিবাচক অর্থাৎ সন্দ্বীপের অর্থনীতি ততটা ভাল নেই এবং সন্দ্বীপে সামাজিক এবং নাগরিক সুযোগ সুবিধার মান প্রয়োজনের তুলনায় অনেক নিন্মমানের। অন্যভাবে বলা যায়, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক অগ্রগতির সাথে সন্দ্বীপ তাল মিলিয়ে আগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত দশকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সত্তেও বাংলাদেশ যেখানে প্রায় ৭ শতাংশ হারে তাঁর দেশজ উৎপাদন বাড়াচ্ছে, সেক্ষেত্রে সন্দ্বীপের অর্থনীতির অগ্র্রগতি এ হারের নিচে অবস্থান করছে। অন্যদিকে নাগরিক সুযোগ সুবিধার ন্যূনতম উপকরণগুলোও সন্দ্বীপে অনুপস্থিত।
আবার যদি প্রশ্ন করা হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সন্দ্বীপীরা কেমন আছে? প্রশ্নটির দু’টি উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি হচ্ছে সন্দ্বীপবাসীদের মধ্যে যাঁরা সন্দ্বীপে অবস্থান করছেন, তাঁরা খুব ভাল নেই। তবে যাঁরা সন্দ্বীপের বাইরে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় অবস্থান করছেন, তাঁরা ভাল আছেন, স্বাচ্ছন্দে আছেন এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
এমতাবস্তায় এমনকি সিদ্ধান্তে আসা যায় Dias Pora সন্দ্বীপীদের মধ্যে সন্দ্বীপের অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ অন্যান্য উন্নয়নে কোন আগ্রহ নেই অথবা বহু যুগ ধরে সন্দ্বীপে রাজকুমার চক্রবর্তী বা কমরেড মুজাফফর আহমেদ এর মত সর্বজন শ্রদ্ধেয়, অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদী নেতৃত্বের অবর্তমানে, বহুধা বিভক্ত সন্দ্বীপীরা নিজের জন্মভূমির উন্নয়নে সক্রিয় নয়। কিংবা বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির যে সমস্ত উপকরণ প্রয়োজন তা সন্দ্বীপে নেই বলে Dias Pora সন্দ্বীপীগণসহ অন্যান্য দেশী বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সন্দ্বীপকে বিনিয়োগের উপযোগী স্থান বলে বিবেচনা করছে না। এমনকি সরকারও সন্দ্বীপে বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা সমূহ দূর করে কাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টিতে মনোযোগ দিচ্ছে না।
Dias Pora সন্দ্বীপীরা স্বমহিমায় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। বহুমুখী অবদানের মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় মানব কল্যাণেরত। দেশী এবং বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারী এবং বেসরকারী কলেজে প্রায় পঞ্চাশোর্ধ পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনকারী Academicians সন্দ্বীপী দেশে মানব সম্পদ উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি দেশের পলিসি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে। দেশ এবং বিদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে এদের রয়েছে চমৎকার পেশাগত সম্পর্ক। সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকারী উর্ধতন কর্মকর্তা সরকারের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামরিক বাহিনীতেও রয়েছে সন্দ্বীপীদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ, রাষ্ট্রীয় এবং দূর্যোগ মোকাবিলায় যাদের সাহসী এবং গঠনমূলক অবদান বাংলাদেশসহ সন্দ্বীপকে গৌরবান্বিত করেছে। সন্দ্বীপের প্রকৌশলী এবং চিকিৎসক সমাজ নিয়েও আমরা গর্বিত। সন্দ্বীপের উদ্যোক্তা শ্রেণী হাজারও বেকারের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনসহ দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধিতে এক অমূল্য অবদান রাখছে। অবাক বিস্ময়ে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয় এসব সৃজনশীল এবং সাহসী উদ্যোক্তাদের যারা কপর্দকহীনভাবে যাত্রা শুরু করে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া আজ দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে উঠে আসা উদ্যোক্তাদের সাথে সমান তালে দেশে ও বিদেশে ব্যবসা করছে। প্রচুর সংখ্যক সন্দ্বীপী শ্রমিক বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায় তা দেশীয় মুদ্রা ভান্ডারকে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ করছে। অধিকন্তু সন্দ্বীপী ব্যাংকার, আইনবিদগণও সন্দ্বীপের তথা বাংলাদেশের অহংকার।
প্রশ্ন আসতে পারে এতসব সফল লোকের জন্ম যে পূণ্যভূমিতে এবং যে পূণ্যভূমির পদযুগল প্রতিনিয়ত সাগরজলে অবগাহিত হয়, সে পূণ্যভূমি কেন সমৃদ্ধ নয়। উত্তর যদি হয় স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত Dias Pora সন্দ্বীপীগণ শুধু নিজ স্বার্থ, সমৃদ্ধি ও সুনাম অর্জনে ব্যস্ত এবং এ বৃত্তের বাইরে তাঁরা কোন চিন্তা করতে পারে না- তবে এ কথা বলা যায় ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদেরকে যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে সম্মান করতে দ্বিধা করবে। আমার উপলদ্ধি ও অভিজ্ঞতা বলছে, বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো সন্দ্বীপীদের হতে পারে না। একটি উদাহরণ এক্ষেত্রে বেশ প্রণিধানযোগ্য হতে পারে।
অতি সম্প্রতি জনাব মোহাম্মদ আবুল কালাম, জনাব শফিকুল আলম ভূঁইয়া ও জনাব মো. আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রাক্তন ছাত্ররা প্রায় সত্তর লক্ষাধিক টাকা সংগ্রহ করে সাউথ সন্দ্বীপ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করে- যা অনেকের মত আমাকেও মুগ্ধ করেছে। কিভাবে সঠিক ও লোভহীন নেতৃত্ব স্বল্প ও বিচ্ছিন্ন শক্তিকে বৃহৎ এবং গঠনমূলক শক্তিতে পরিণত করতে পারে, যা প্রত্যক্ষ করে অনেকের মত লেখকও মুগ্ধ হয়েছে। সন্দ্বীপীরা অবশ্যই সন্দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে এ রকম আরো অনেক মহৎ কাজ করছে- যা হয়তো আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। সন্দ্বীপীদের এ সহজাত শক্তিকে পূঁজি করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সন্দ্বীপীগণ যদি যৌথভাবে এগিয়ে আসে তাহলে সন্দ্বীপের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা যেমন দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তাল মিলিয়ে এগুতে পারবে, তেমনি সন্দ্বীপে অবস্থানকারী সন্দ্বীপবাসীগণ সন্দ্বীপের বাইরে অবস্থানকারী সন্দ্বীপীদের মত খুব ভাল না থাকলেও কিছুটা স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে। ফলশ্রুতিতে বর্তমানে সন্দ্বীপ থেকে যে ঢালাও Migration হচ্ছে তার প্রবণতা কিছুটা রোধ হবে। এক্ষেত্রে লেখকের কিছু পরামর্শ নিন্মবর্ণিত হল।
১. শিল্পায়নঃ শিল্পায়ন ছাড়া কোন অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভব নয়। ঐতিহাসিকভাবে এ দ্বীপাঞ্চল নৌকা, সাম্পান ও জাহাজ তৈরীসহ লবন উৎপাদনে বিখ্যাত ছিল। অধিকন্তু বিক্ষিপ্তভাবে বিড়ি উৎপাদনসহ Light weight Engineering এর বেশ কিছু ছোট শিল্প সন্দ্বীপে ছিল। সন্দ্বীপী শিল্পপতিগণ একটি প্রাথমিক গবেষণা চালিয়ে এবং গবেষণালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি করে শ্রমঘন কিছু শিল্প সন্দ্বীপে স্থাপন করতে পারেন। আমার ধারণা মতে সন্দ্বীপে মৎস্য, কাঠ এবং লবনসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট এবং মাঝারি আকারের শিল্প স্থাপন হতে পারে। অধিকন্তু Solar Energy এবং পাশাপাশি কিছু Wind Mill স্থাপন করতে পারলে পরিবার থেকে শুরু করে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সবুজ শক্তির (Green Energy) সঞ্চারনের ব্যবস্থা করা যেত। উল্লেখ্য যে, ২০১৪ সালে জার্মান সফরের সময়, Wind mill এবং Solar Energy এর যুগপৎ অবদানে কিভাবে সে দেশের পরিবার পর্যায় থেকে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হচ্ছে - তা দেখার বিরল সুযোগ লেখকের হয়েছিল। অধিকন্তু ক্ষুদ্র হলেও সন্দ্বীপের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিসিক নগরীর আদলে শিল্পাঞ্চল গঠন করা যেতে পারে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবীটা উপস্থাপনের সাথে সাথে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এরকম অঞ্চলে সন্দ্বীপে আমদানি বিকল্প ছোট ছোট শিল্প প্রথম পর্যায়ে স্থাপন করে পরে এ অঞ্চলের বাইরে বিক্রয়যোগ্য এমনকি বিদেশে রপ্তানী যোগ্য বিভিন্ন শিল্প স্থাপন করা যেতে পারে।
২.কর্মসংস্থানঃ সন্দ্বীপীদের কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে কিছু কৌশল নেয়া যেতে পারে। সন্দ্বীপে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের সেবা ও শিল্পখাত সৃষ্টি কর্মসংস্থানের সর্বোত্তম মাধ্যম হতে পারে। তবে সন্দ্বীপীদের মালিকানাধীন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সহ অন্যান্য অঞ্চলে অবস্থিত শিল্প ও সেবাখাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে সন্দ্বীপী যুব সমাজকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা গেলে দ্বীপাঞ্চলের লোকদের বেকার সমস্যার কিছুটা সমাধান করা সম্ভব হতে পারে। অধিকন্তু সন্দ্বীপীদের দেশের বাইরে যাওয়া স্বভাব প্রসুত ও বটে। কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বহির্গমনে ইচ্ছুক সম্ভাব্য যুবকদের ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা গেলে অন্ততপক্ষে অদক্ষ প্রচুর জনশক্তি সেমি-দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হতে পারে। সেক্ষেত্রে বহির্গমনকৃত যুবকরা অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে সন্দ্বীপসহ দেশের উন্নয়নে বেশী ভূমিকা রাখতে পারবে।
৩. কৃষিঃ যে কৃষি মূলতঃ সন্দ্বীপবাসীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম ছিল মান্ধাতার আমলের প্রযুক্তির কারণে সে কৃষিকাজ যুবক শ্রেণীর কাছে আজ এক অগ্রহণযোগ্য পেশায় পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে রেমিটেন্সের কুপ্রভাবও রয়েছে। যে পিতা কৃষিকাজ করত কিন্তু বর্তমানে বিদেশে শ্রম প্রদান করছে তাঁর সন্তানটি নিজস্ব জমিতে কৃষিকাজের পরিবর্তে বিভিন্ন অসামাজিক কাজ সহ গ্রামের নোংরা রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছে। যে কৃষি বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের ১৯.৩ ভাগ অবদান রাখছে, সে কৃষিকাজ থমকে পড়লে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার আশংকা থাকে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে এ ব্যাপারে যথাযথ ভূমিকা রাখার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিকাজকে উৎসাহিত করার জন্য অনেকগুলো Refinancing Scheme চালু করেছে - যা বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এগুলোর মধ্যে Share cropper Financing অন্যতম। সন্দ্বীপে অবস্থিত ব্যাংকগুলোসহ সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী দেশের অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত ব্যাংকারগণ এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে অর্থায়নের মাধ্যমে কৃষিকাজ প্রাণচাঞ্চল্য ফেরত আনতে পারে। অধিকন্তু লিজিং এর মাধ্যমে আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে যুবক সমাজকে এ পেশায় বেশী করে আকৃষ্ট করা যেতে পারে।
৪.যোগাযোগঃ যোগাযোগ ব্যবস্থার করুণ চিত্রের কারণে সন্দ্বীপ দেশের মূল ভূখন্ড হতে বিচ্ছিন্ন, বিশেষ করে বর্ষাকালে এ বিচ্ছিন্নতা তীব্র রুপ ধারন করে। সঠিক স্থানে জেটি ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক দ্রুতগতি সম্পন্ন জাহাজ এর ব্যবস্থা করা গেলে এ সমস্যার উপশম সম্ভব। অধিকন্তু সপ্তাহে অন্তত এক বা দু’দিন হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা গেলে সন্দ্বীপের লোকজন যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তিবোধ করবে। এ সমস্যার পরিপূর্ণ সমাধানের জন্য সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রামের উপযোগী স্থানের সাথে সেতু স্থাপন করা ছাড়া বিকল্প নেই। শেষের প্রস্তাবনাটি একটি স্বপ্ন হলেও সন্দ্বীপের ভবিষ্যত প্রজন্ম তা বাস্তবে দেখবে এবং ভোগ করবে তা অবশ্যই প্রত্যাশিত।
৫. ভূমি উদ্ধারঃ বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অপরিবেশ বান্ধব শিল্প বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় কিভাবে সন্দ্বীপ ক্রমাগতভাবে ভাংগনের শিকার হয়ে সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হচ্ছে তা আপতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমাদের নীতি নির্ধারকদের অগোচরে রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে যথাযথভাবে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দেশের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সহযোগিতা প্রয়োজন। অধিকন্তু সন্দ্বীপের নাড়ীর সাথে সম্পর্কিত সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্যোগ এবং গবেষকদের বাস্তবভিত্তিক গবেষণা করা প্রয়োজন। পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের ফলে সন্দ্বীপের বহুমুখী ক্ষতির মোট পরিমাণ যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারলে সন্দ্বীপের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের একটি দুয়ার উন্মোচন হতে পারে - যা থেকে সন্দ্বীপ ও দেশ উভয়ই উপকৃত হবে। সন্দ্বীপ-উরিরচর-নোয়াখালী ক্রসড্যাম নির্মিত হলে, যে বিশাল স্থলভূমির উদ্ধার হতে পারে তা নীতি নির্ধারকদের নজরে আনা সহ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে প্রয়োজনীয় তদবির/ লবিং করা প্রয়োজন। এ কথা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে বোঝানো প্রয়োজন এ ব্যবস্থা নেয়া হলে জনসংখ্যার ভারে আক্রান্ত এ দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বসবাসের জন্য কিছুটা বাড়তি জায়গা পাওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, এরকম একটি ক্রসড্যাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এর স্বপ্ন ছিল যা তিনি এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠির কাছে ব্যক্ত করেছিলেন। অধিকন্তু বর্তমানে সন্দ্বীপের পশ্চিম দিকে মেঘনা নদীতে উদীয়মান বিভিন্ন ছোট ছোট দ্বীপগুলো যাতে সন্দ্বীপের সাথে যুক্ত থাকে সেদিকেও সন্দ্বীপের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সরকারী কর্মকর্তাদের নজর রাখা প্রয়োজন।
৬. চিকিৎসাঃ সন্দ্বীপে বিদ্যমান চিকিৎসার মান, রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি এবং হাসপাতালের অবকাঠামো বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছে নিঃসন্দেহে বলা যায়। অথচ যেহেতু যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত, এখানে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত- যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরকম মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চলে দেখা যায়। কমিউনিটি হাসপাতাল সহ বিদ্যমান হাসপাতালগুলো মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানে নিঃসন্দেহে সন্দ্বীপে অবদান রাখছে। কিন্তু মাতৃকালীন চিকিৎসাসহ জরুরী চিকিৎসা প্রদানের জন্য যোগ্য চিকিৎসক সহ যথাযথ অবকাঠামো সন্দ্বীপে এখানো গড়ে ওঠেনি। এ প্রসংগে আমার একটি অভিজ্ঞতা পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন করছি। প্রসবকালীন চিকিৎসার জন্য আমার এক গরীব আত্মীয়াকে স্থানীয় ডাক্তার হঠাৎ করে রাত্রে চট্টগ্রাম যাওয়ার পরামর্শ দিলে, সে আত্মীয়া এবং তাঁর পরিবারবর্গ এক অসহনীয় অবস্থার সম্মুখীন হয়। পরে বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে দীর্ঘসময় পর চট্টগ্রাম এসে পৌঁছালে তিনি অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান। উল্লেখ্য যে, সন্দ্বীপে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। স্থানীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে হয়তো এ অবস্থার উদ্ভব হত না। এক্ষেত্রে বেসরকারী উদ্যোগে যোগ্য চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি বা দুইটি বেসরকারী হাসপাতাল গড়ে তোলা যেতে পারে। অধিকন্তু তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ আবিষ্কার কাজে লাগিয়ে ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে সন্দ্বীপের গুণী চিকিৎসকগণ সন্দ্বীপের রোগীদেরকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন। ঢাকায় অবস্থিত স›দ্বীপ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম একটি স্থায়ী অফিসের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এরকম একটি স্থায়ী অফিস করা সম্ভব হলে সেখান থেকে সন্দ্বীপী ডাক্তারগণ স্থানীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে এ পদ্ধতিতে সাধারণ জনগণকে চিকিৎসা প্রদান করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, ভিডিও/ টেলি কনফারেন্স এর মাধ্যমে ঢাকাস্থ গুণী চিকিৎসকগণ স্থানীয় চিকিৎসকগণকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিংও প্রদান করতে পারেন।
৭.শিক্ষা, গবেষণা ও ঐতিহ্যঃ সন্দ্বীপে বিদ্যমান শিক্ষার হার ও গুণগত মান দুটোই আমাদেরকে ভাবিত করছে। The Gurdian পত্রিকার সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৩ সংখ্যার তথ্য অনুসারে সন্দ্বীপের শিক্ষার হার ৪৭.৭২ শতাংশ, অথচ শিক্ষার হার চট্টগ্রাম বিভাগে ৫৮.৯০ শতাংশ এবং বাংলাদেশের শিক্ষার বর্তমান হার ৭১ শতাংশ। উপরের তথ্য আমাদের শিক্ষার হারের দীনতা প্রকাশ করছে। অধিকন্তু শিক্ষার মান নিয়ে সুধী সমাজ চিন্তিত। স্কুল পর্যায় থেকে কম্পিউটার এবং ইংরেজী শিক্ষার মান দুর্বল হলে ছাত্রছাত্রীগণ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সমস্যার সম্মুখীন হয়। সন্দ্বীপের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ বিষয়গুলোর যোগ্য শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ সন্দ্বীপীগণ সন্দ্বীপের স্কুল গুলোকে কিভাবে সাহায্য করতে পারেন তা বিবেচনা করতে পারেন।
সমুদ্র সম্পদের উপর গবেষণা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য- এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। এ অপরিহার্যতা আরো বাড়তি মাত্রা লাভ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সাম্প্রতিক সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে। সমুদ্রের যে বিশাল খনিজ ও মৎস্য সম্পদ রয়েছে তাঁর সঠিক ব্যবহারসহ উৎকর্ষ সাধনে বিভিন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ধরনের কিছু ইনস্টিটিউট সন্দ্বীপে হলে সন্দ্বীপসহ বাংলাদেশ লাভবান হবে। সন্দ্বীপের রাজনীতিবিদ ও সরকারী কর্মকর্তাসহ সবাই এ ব্যাপারটা নিয়ে সরকারের যথাযথ মহলে চাপ বা সুপারিশ করলে সুফল আসতে পারে।
পরবর্তী প্রজন্মের জ্ঞানার্জনের জন্য সন্দ্বীপের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। দেখা যায় সন্দ্বীপের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অনেকগুলো গবেষণাধর্মী নথি, প্রবন্ধ ও বই রয়েছে। এগুলোর প্রকাশনার ক্ষেত্রে সন্দ্বীপ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম এবং সন্দ্বীপ এডুকেশন সোসাইটি চট্টগ্রামকে ধন্যবাদ দিতে হয়। প্রকাশিত বইগুলো সংরক্ষিত হলে সন্দ্বীপসহ দেশ ও পৃথিবীর ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে। পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকগণও গবেষণার কিছু তথ্য এখান থেকে পাবেন। স›দ্বীপের মধ্যে কোন সরকারী বা স্বায়ত্তশাসিত সংগঠন অথবা ঢাকা ও চট্টগ্রাম ভিত্তিক সন্দ্বীপের সংগঠনগুলো স›দ্বীপ সংক্রান্ত প্রকাশনাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।
উপরে বর্ণিত প্রস্তাবনাগুলো নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য, সকলের বোধগম্য ও বহুল আলোচিত। কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস সন্দ্বীপীগণ যে মেধা, কর্মকুশলতা, যোগ্যতা ও বিশ্বাস লালন করে, একমাত্র তাঁদের পক্ষে সম্ভব নিজের নাড়ীর টানে শক্ত করে বাঁধা সদ্বীপের এসব চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে সন্দ্বীপের মাটিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পীঠস্থানে পরিণত করা। তবে তাঁর জন্য প্রয়োজন একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে চলা। রাজনীতির সংকীর্ণ বৃত্তের বাইরে গিয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজের প্রভাব বিস্তার করার মানসিকতা ত্যাগ করে আমরা সবাই সন্দ্বীপের উন্নয়নের প্রয়োজনে যৌথভাবে এগিয়ে আসব - এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
লেখক : পরিচালক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)।