সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টার
প্রসূতির মৃত্যু রহস্য ধামা-চাপা দেয়ার চেষ্টা
প্রকাশিত : ১১:০৬ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১১:১৫ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৮ রবিবার
চিকিৎসকের ভুল পরামর্শে শিশু রাইফার মৃত্যু শোক দেশবাসিকে শোকের সাগরে ভাসিয়েছে। সেই শোক কাটতে না কাটতেই এবার সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টারে অনভিজ্ঞ ডাক্তারের হাতে প্রাণ গেল উপজেলার প্রসূতি আক্তারা বেগমের (৩৫)।
গত ২৪ অক্টোবর সকাল ১১টায় গৃহবধূ আক্তারা বেগমের বাচ্চা প্রসবের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টারে।
৫ম সন্তানের প্রসবকালীন সময়ে বাড়ীতে ডেলিভারী নিরাপদ মনে না করে তার স্বামী ট্রলারের কর্মচারী মো. জিয়া তাদের পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডস্থ লেমু হোসেনের বাড়ী হতে ২৪ আগষ্ট দুপুর ২ টার দিকে সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টারে এনে ভর্তি করান। সিজারিয়ান অপারেশনে পুত্র সন্তানের জন্ম দেন আক্তারা। কিন্তু অদক্ষ ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় সন্তান পৃথিবীর আলো দেখলেও আক্তারা বেগমের মৃত্যু হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে সন্দ্বীপ উপজেলার সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টার নামে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। অভিযোগ উঠেছে ডাক্তারের ভুল আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিতেই মৃত্যু হয়েছে আক্তারা বেগমের।
স্বজনদের অভিযোগ, ঈদে সবাই ছুটিতে থাকায় কোন এনেস্থিসিয়া ও গাইনী ডাক্তার ছাড়াই মাহফুজুর রহমান নামে একজন এমবিবিএস ডাক্তার সিজারিয়ান অপারেশন করার সময় পেটের বিভিন্ন রগ কেটে গিয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে।
আক্তারা বেগমের মৃত্যুর দু’দিন পেরিয়ে গেলেও সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টারে গত ২৪ আগষ্ট অপারেশন থিয়েটারে প্রকৃত পক্ষে কী হয়েছিলো তা এক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।
ওই দিন সন্ধ্যা ৭টায় সিজারের মাধ্যমে একটি পুত্র সন্তান হয়। কিন্তু সিজারের পরপরই ক্ষতস্থান হতে রোগীর প্রচন্ড রক্তপাত হতে থাকে। তাৎক্ষনিক রক্ত দেওয়ার চেষ্টা করেও তাকে আর বাঁচাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ডা.মাহফুজুর রহমান।
তিনি দাবী করেন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণেই প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু কেন এ অনাকাংখিত মৃত্যু? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে জানা গেলো চাঞ্চল্যকর তথ্য। যে ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে সিজার করিয়েছেন প্রকৃত পক্ষে তিনি কোন গাইনী ডাক্তার নন। একজন এনেসথেশিয়া মাত্র।
এ ব্যাপারে সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডাক্তার ফজলুল করিম জানিয়েছেন, ‘ডাক্তার মাহফুজুর রহমানের এমবিবিএস ডিগ্রি ছাড়া আর কোন ডিগ্রি নেই। এখন প্রশ্ন হলো-সিজার অপারেশনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারকে কী অভিজ্ঞ হলে চলে? না কী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে হয়, যার সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোন মেডিক্যাল থেকে গাইনী বিষয়ে ডিগ্রী থাকবে? রোগীর জীবন নিয়ে খেলা করার এ অধিকার ঐ ডাক্তার (ডা.মাহফুজুর রহমান) কে দিলো? এ প্রশ্ন আজ সন্দ্বীপের প্রতিটি মানুষের।
যোগাযোগ করা হলে একুশে টিভি অনলাইনকে সন্দ্বীপ থানার ওসি মো. শাহজাহান বলেন, ঘটনাটি অতীবও দুঃখজনক। ভুল চিকিৎসায় যদি রোগীর মৃত্যু হয় এটি সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এমন ডাক্তার আমাদের প্রয়োজন নেই। এ ঘটনায় কেউ অভিযোগ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই ব্যাপারে একুশে টেলিভিশন অনলাইন থেকে সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টারের ম্যানেজার সাইফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এর আগেও সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ওঠে। এখানে নরমাল ডেলিভারী রোগী আসলেও তাদের বিভিন্ন ভাবে ভয় দেখিয়ে সিজারিয়ান অপারেশন করতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে। আবেদা ফয়েজ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আক্তার হোসেন অভিযোগ করে জানান, আমি আমার ছোট বোনকে ডেলিভারি করানোর জন্য এখানে আনলে ডাক্তাররা বলেন বাচ্চা পেটের ভেতর পায়খানা করে পায়খানা খেয়ে ফেলেছে। তাকে দ্রুত অপারেশন করে বাচ্চা বের করতে হবে। কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে পরদিন চট্টগ্রাম নেওয়ার জন্য বাড়ি নিয়ে আসলে সেখানেই তার নরমাল ডেলিভারী হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাক্তার মাহফুজুর রহমান ২০১৬ সালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে সন্দ্বীপের হরিশপুর ১০ শয্যা সরকারি হাসপাতালে বদলি হয়ে আসে। একই সময় সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি অবৈধভাবে সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে নিয়োগ নেন। এরপর থেকে সরকারি হাসপাতালে না বসে সকাল থেকে মেডিকেল সেন্টারে রোগী দেখা শুরু করেন। সরকারি হাসপাতালে কোন রোগী আসলে তাদেরকেও মেডিকেল সেন্টারে এসে চিকিৎসা নিতে বাধ্য করতেন।
ডাক্তারের অনিয়মের ব্যাপারে সাধারণ রোগীরা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ ফজলুল করিমকে এসব অভিযোগ করলে তিনি বিষয়টি সিভিল সার্জনকে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিষয়টি সীতাকুণ্ডের উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তদন্ত করলে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় এবং ডাঃ মাহফুজুর রহমানকে শাস্তিমূলক মহেশখালীতে বদলী করা হয়। সেখানে নিয়োগ হওয়ার পরেও কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে নিয়মিত রোগী দেখতে থাকেন। বিষয়টি জানাজানি হলে তাকে মহেশখালী থেকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলা হাসপাতালে বদলী করা হয়।
সেখান থেকেও একইভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে রোগী দেখা অব্যাহত রাখেন। কর্মস্থলে নিয়মিত অনুপস্থিত থাকার কারনে তাকে অনেকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান নাইক্ষ্যাংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ সেলিম।
তিনি জানান, ডাঃ মাহফুজুর রহমানকে আমরা হাসপাতালে পাইনা। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে বান্দরবান জেলার সিভিল সার্জনকে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে বান্দরবান জেলার সিভিল সার্জন ডাঃ অং স্রু প্রু মারমা বলেন, ডাঃ মাহফুজুর রহমানের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে এবং তা তদন্তের জন্য ৩ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছিল। তারা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে এবং তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
এলাকা সূত্রে জানা যায়, এদিকে সাড়ে ৪ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকার বিনিময়ে দরিদ্র ট্রলার কর্মচারীর স্ত্রীর মৃত্যু বিষয়টি দফা-রফা হওয়ায় নিহত আকতারার স্বামী জিয়া এ ব্যাপারে বেশি কথা বলতে নারাজ। তার কথা, ফয়সালা হয়ে গেছে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করে কী লাভ? আর দফা-রফা যারা করেছেন-তারা দলীয় নেতা হতে শুরু করে এলাকার চেয়ারম্যান, কলেজের প্রভাষক, ব্যবসায়ী নেতাও ছিলেন। ফলে বিষয়টি আর বেশি দূর এগুতে দেননি তারা।
এদিকে আজ সকালেই (২৬ আগষ্ট) ঐ ডাক্তার (মাহফুজুর রহমান) গোপনে সন্দ্বীপ ত্যাগ করেছেন বলে জানা গেছে। সে বর্তমানে বান্দরবানের নাইখ্যাংছড়ি উপজেলা সরকারী হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসক বলে জানা গেছে। তবে বেশির ভাগ সময়ই তাকে চুক্তিভিত্তিক চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সন্দ্বীপ মেডিক্যাল সেন্টারে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
কেআই/এসি