বিবিসি’র বিশ্লেষণ
প্রতিষ্ঠার চল্লিশে বিএনপি কি সবচেয়ে কঠিন সময়ে?
প্রকাশিত : ০৫:৫৭ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার
বাংলাদেশে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে কি না? দলটি প্রতিষ্ঠার ৪০ বছরে এই প্রথম শীর্ষ নেতৃত্বকে ছাড়া প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে। দলটির শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন এবং দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারছেন না। বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই পরিস্থিতিতে বিএনপি সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, কঠিন সময়েও তাদের কেউ দল ছেড়ে যায়নি বা দলে বিভক্তি আসেনি। তবে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বিএনপি বয়কট করেছিল। এখন আবার আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে দলটি আরো সংকটে পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন। ৪০ বছরে এসে বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশ নেওয়া, না নেওয়ার প্রশ্নে টানাপোড়েনে পড়েছে, দলটির নেতা কর্মীদেরও অনেকে তা মনে করছেন।
বিএনপির সংকট আসলে কতটা: দলটি ১২ বছর ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এমনকি ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করে পাঁচ বছর ধরে বিএনপি সংসদেও নেই। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জন্মের পর থেকে দলটি এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকেনি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একটি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে রয়েছেন প্রায় সাত মাস ধরে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১শে অগাস্টে গ্রেনেড হামলায় কমপক্ষে ২২জন নিহত হওয়ার ঘটনার এই মামলায় বিচার কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে এসেছে। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি বড় সংকটে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও বলেছেন, তাদের দলকে এখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। ইতিপূর্বে যতগুলো ক্রাইসিস হয়েছে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যু, পরবর্তীকালে ক্ষমতা থেকে দূরে সরে যাওয়া। পরবর্তীকালে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসা। ওয়ান ইলেভেনের মধ্যে আবার গ্রেফতার হওয়া। তারপরও আজকে এই সংকটটা আমার কাছে মনে হয় আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট।
আলমগীর আরো বলেন, এর মধ্যে নির্বাচন এসে গেছে। আমাদের নেত্রীকে জেলে রাখা হয়েছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন দেশের বাইরে। আমাদের অসংখ্য নেতা-কর্মী জেলে। মামলা মোকদ্দমা আমাদের সকলের বিরুদ্ধে রযেছে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি, সংকট কাটাতে বিএনপির চেষ্টা কতটা প্রবল ছিল: সরকারের কঠোর আচরণের মুখে বিএনপি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা সফল হয়েছে, সেটাও বলা যায় না। বিএনপি যদি এবার নির্বাচনে অংশ নেয়, সেই নির্বাচনের কয়েক মাস আগেও মাঠে দলটির প্রস্তুতি দৃশ্যমান নয়। যদিও দলটির নেতারা বলে থাকেন, মামলার কারণে তাদের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ এখনও স্ব-স্ব এলাকায় যেতে পারেন না।
কিন্তু বিভিন্ন জেলায় বিএনপির তৃণমূলের কয়েকজন নেতা-কর্মীর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্র থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি রয়েছে।
বিএনপির শক্ত অবস্থান রয়েছে, এমন একটি জেলা রাজশাহী থেকে দলটির একজন নেত্রী রোকসানা পারভীন বলছিলেন, জনসমর্থন তাদের দলকে টিকিয়ে রেখেছে।
বিএনপির সাপোর্টার অনেক। নেতাদের কোনো কিছু দেখি না যে কর্মীদের সুন্দরভাবে রাখবে। তারপরও অন্তত জনসাধারণের জন্য দল চলতে হবে।
খালেদা জিয়ার মুক্তি নাকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ, এখন কোনটি বিএনপির ইস্যু: বিএনপির নেতা কর্মীদের অনেকে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য বলে মনে করেন। কিন্তু দলটির বড় অংশ খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে নয়।
ঢাকায় বিএনপির ধানমন্ডি এলাকার একজন নেত্রী রোজিনা আকতার বলেছেন, তাদের নেত্রীর মুক্তির বিষয়টিই নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রধান শর্ত হতে পারে বলে মাঠ পর্যায়ে তারা মনে করেন। নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিই এখন বিএনপির কাছে বড় ইস্যু। নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি যে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নেয়নি, সেই বাস্তবতা বিএনপি বিবেচনায় নিয়েছে বলে মনে হয়।
বিএনপির চ্যালেঞ্জ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসিফ নজরুল মনে করেন, এখনকার পরিস্থিতিতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার বিষয়টিই বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস হচ্ছে বিএনপির, তারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে বা বাস্তবায়ন করতে, যে সুদৃঢ় মনোভাব তাদের লাগে এবং যে ক্রেডিবিলিটি দেশের ইনটেলেকচ্যুয়াল এবং প্রগতিশীল মহলের কাছে লাগে, সেখানে তাদের ঘাটতি রয়েছে।
বৃহত্তর ঐক্যের বাধা: আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরের অন্য সব দলকে নিয়ে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যের চেষ্টাও এখনও সফল হয়নি। সেখানে বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর ঐক্য অন্যতম একটি বাধা হয়ে আসছে। যদিও দল দু`টি স্ব-স্ব স্বার্থে একে অপরকে ছেড়ে যাবে না, সেটা অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে আসিফ নজরুল মনে করেন, বিএনপিকে এখন নিজের স্বার্থেই জামায়াতকে ছেড়ে আসা উচিত। বিএনপিকে অবশ্যই বৃহত্তর ঐক্যের পথে যাওয়া উচিত। বিএনপির উচিত জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে দেয়া।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন যারা বর্জন করেছিল, এরকম কামাল হোসেনের দল, বদরুদ্দোজা চৌধুরীর দল এবং বামপন্থীদলগুলোকে নিয়ে একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা উচিত। বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।
সিদ্ধান্ত নেয়ার চ্যালেঞ্জ: আসলে খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে বিএনপির সিনিয়র নেতারা কোনো ইস্যুতেই ঝুঁকি নিতে চান না বলে মনে হয়।
তারা লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের সাথে কথা বলার পর নিজেরা আলোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জেলে খালেদা জিয়ার সাথেও তাদের যোগাযোগ হচ্ছে।
সর্বশেষ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলীয় নেত্রীর সাথে কারাগারে দেখা করেছেন। এমন অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় দলের কৌশল নির্ধারণ চ্যালেঞ্জের বিষয় বলেই বিএনপির নেতারা বলছেন। তারা মনে করছেন,আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ডের কারণে বিএনপির জনসমর্থন অনেক বেড়েছে এবং তারা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন।
ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়: বিএনপি নেতা আলমগীর বলেছেন, জনসমর্থন এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়কে শক্তি হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তারা সিদ্ধান্ত নেবেন। এদেশের মানুষ এখনও বিএনপির সঙ্গে রয়েছে এবং বিএনপির নেতা-কর্মীরাও কেউ কিন্তু ভয়ে বা অত্যাচারে নির্যাতিত হয়েও এখন পর্যন্ত বিএনপি ছেড়ে কোথাও যায়নি। সেজন্যই আমি মনে করি, দেশনেত্রীকে মুক্ত করেই আমরা নির্বাচনে যাব। এই প্রত্যাশা আমরা করি।
আরকে//