শুভ জন্মাষ্টমী, শান্তি আসুক ধরাধামে
ধীরাজ কুমার নাথ
প্রকাশিত : ০৭:২৩ পিএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার
বিশ্বের একমাত্র অধীশ্বর যিনি, তিনি আদি ও অনাদি, সর্বকারণের কারণ, তিনিই গোবিন্দ এবং তিনিই হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। ঈশ্বর সনাতন, চিরস্থায়ী এবং তিনিই সনাতন ধর্মের স্রষ্টা। মানুষ নশ্বর, তার দ্বারা এরূপ কোনো চিরস্থায়ী বা সনাতন কিছুই হতে পারে না। স্বয়ং ঈশ্বর সনাতন হিন্দুধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারক, ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাণী ঋষিদের মাধ্যমে এভাবে পৃথিবীতে প্রবর্তিত হয়েছে। তাই সনাতন অর্থ শাশ্বত বা চিরস্থায়ী, যা আগে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
ত্রিলোকদর্শী ঋষিরা ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে ঈশ্বর থেকে এ জ্ঞান লাভ করেছেন যে, সবকিছুই ঈশ্বর সৃষ্ট। তিনিই একমাত্র প্রভু, মহাজ্ঞানী এবং মহাশক্তিধর, তিনিই বিশ্বব্রহ্মা-ের নিয়ন্ত্রা। ঈশ্বর সম্পর্কে যে জ্ঞান গভীর তপস্যার ফলে জ্ঞাত ঋষিদের মাধ্যমে প্রবর্তিত হয়েছিল তাকেই ‘বেদ’ বলা হয়। লিপিমালার উদ্ভব হয়নি প্রথমদিকে তাই এই জ্ঞান ঋষিদের মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল বলে একে বলা হয়, ‘শ্রুতি’। পরবর্তীকালে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রচুর পরিশ্রম করে ঋষিদের শিষ্যদের কাছ থেকে এ জ্ঞান সংগ্রহ করে ও সঙ্কলন করে লিপিবদ্ধ করেন। তিনিই ‘বেদব্যাস’ নামে বহুল পরিচিত। এভাবেই বিশ্বের অন্যতম প্রধান স্বতন্ত্রধর্মী ও দর্শনভিত্তিক ধর্ম হিসেবে ‘সনাতন ধর্ম’ রূপলাভ করে।
এই সনাতন ধর্মে ঈশ্বর অত্যন্ত আপনজন বলে স্বীকৃত। তিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্বব্যাপী। বিশ্বব্রহ্মা- তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে ঈশ্বর সতত বিরাজমান। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার। সাকাররূপে প্রকৃতিতে তিনি প্রকাশিত, নিরাকাররূপে সমগ্র নভোম-লে তিনি বিরাজিত। তিনি ইচ্ছা করলেই রূপ পরিগ্রহ করতে পারেন। তিনি তা করেছেন এবং করবেন যুগের সন্ধিক্ষণে, সাধুদের পরিত্রাণের লক্ষ্যে, দুষ্টের দমনের জন্য এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লেখ আছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ‘হে অর্জুন! যে সময়ে ধর্মের গ্লানি বা অধঃপতন হয়, সেই সময়ে আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। সাধুদের পরিত্রাণ, পাপীদের বিনাশ এবং ধর্মকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমি যুগে যুগে ধরায় অবতীর্ণ হই।’
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধরায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৩২২০ বছর আগে অর্থাৎ প্রায় এখন থেকে ৫২৩৬ বছর আগে। এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে। শ্রীকৃষ্ণ ধরায় আগমন করে সাধুদের রক্ষা এবং দুর্বৃত্তদের বিনাশ করেছেন এবং বিশ্বব্রহ্মা-ের সর্বোচ্চ মহাধিকরণ হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন, এসব বর্ণনা আছে গর্গ সংহিতায়, বিষ্ণুপুরাণে, ব্রহ্মাবৈর্বত্যপুরাণে, মহাভারতে, হরিবংশে, ভাগবতসহ অসংখ্য ধর্মগ্রন্থে।
বিষ্ণুর অষ্টম অবতার, জননীর অষ্টম গর্ভের সন্তান, অষ্টমীতে আবির্ভূত হয়েছেন এ ধরায়। তাই ভগবানের আবির্ভাবের মুহূর্তকে বলা হয় জন্মাষ্টমী। বিবেকের চেতনাকে বিকশিত করে বিশ্বকে প্রেম, প্রীতি ও প্রকৃতির ধারায় প্রবাহিত করে ধর্মকে প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তার আবির্ভাব। শ্রীকৃষ্ণের নীলাভ রঙ হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মা-ের প্রতীক, অনন্ত আকাশের নীলাভ ছবির রূপ, এ হচ্ছে গভীর সমুদ্রের নীল রঙের অসাধারণ অবয়ব। অসীম ভালবাসা, দুঃখ-বেদনা, জয়-পরাজয়, সংগ্রাম ও সংহতির মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, মাথায় যার ময়ূর পুচ্ছ, সৌন্দর্য ও জ্ঞানের প্রতীক, হাতে পাঞ্চজন্য, সত্য ও সংহতির সুর। তাই ভগবান বলছেন, ‘আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে স্বকীয় শক্তির বলে সৌরজগৎকে ধারণ করে আছি।’ (গীতা১৫/১৩)
ভগবান একাধারে বালগোপাল, ভ্রাতা, রথের সারথি, যোদ্ধা, দক্ষ কূটনীতিজ্ঞ, দার্শনিক, জ্ঞানপিপাসু শিষ্য, রক্ষাকর্তা। তিনি একই সঙ্গে ব্রজের রাখাল, বৃন্দাবনের গোপী মনমনোহারিনী, আবার দ্বারকার রাজা। এর অর্থ হচ্ছে, বিশ্বভুবনে এ শৃঙ্খলিত জীবনকে সাথী করে, মহামায়া ছেড়ে দিলেন মহাকাশে, পরিণতি হলো উন্মুক্ত বিশ্বভুবন তার বিচরণক্ষেত্র। অর্থাৎ হে মানব, শৃঙ্খলকে পরাভূত করে বিচরণ করো মুক্ত আকাশে, অত্যাচারীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে বা অসত্যের বিনাশ করে মুক্ত বিশ্বে সত্যকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অবতীর্ণ হও। তাই বেদান্তের শিক্ষক চিনময়ানন্দ বলেছেন, ‘গীতার মাধ্যমে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ উপনিষদের জ্ঞানকে হিমালয় থেকে সাধারণ পণ্যের বাজার অবধি পরিব্যাপ্ত করেছেন।’
স্বামী শিবানন্দ গীতার ওপর ব্যাপক গবেষণা করে বলেছেন, ‘গীতা দৈনন্দিন জীবন এবং ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। গীতা জীব ও জগতের কল্যাণে, ভালবাসার মধ্য দিয়ে কর্তব্য পালনের এক শিক্ষা। হৃদয় থেকে স্বার্থপরায়ণতা, লালসা এবং কামনা দূরীভূত করে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করাই গীতার শিক্ষা।’ গীতার এসব বাণীই হচ্ছে পার্থসারথি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ নিঃসৃত বাণী।
পরমগুরু শংকরাচার্য, শ্রী রামানুজ, শ্রীমাধব এবং বিশ্বের অনেক দার্শনিক গীতার ওপর গবেষণা করেছেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী অবলোকন করে বিমোহিত হয়েছেন। ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণননের মতে, ‘গীতা শুধু চিন্তার শক্তি এবং দর্শনের মহিমায় আমাদের আকর্ষণ করে না, ভগদ্ভক্তির উত্তাপে এবং আধ্যাত্মিক আবেগের মধুরতায় আমাদের বিমুগ্ধ করে।’ লোকমান্য তিলক বলেন, ‘ইহা অত্যন্ত প্রোজ্জ্বল ও অমূল্য রতন যা উৎপীড়িত আত্মাকে শান্তি দেয় এবং আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞায় প্রভু করে তোলে।’
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-প্রীতি, জন্ম-মৃত্যু সবই জীবনের অঙ্গ। এগুলোকে সহজভাবে সত্য ও ন্যায়ের আলোকে সঠিকভাবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সনাতন ধর্মীয় গ্রন্থগুলো প্রায় সবই ঋষি মুখে কথিত। একমাত্র ব্যতিক্রম শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা। এখানে স্বয়ং শ্রীভগবান নিজেই বক্তা। গীতা হচ্ছে ঐশ্বর্যময় ঈশ্বরের গান। ভগবানের গুণকীর্তন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে হতাশ তৃতীয় পা-ব অর্জুনকে মানুষের ভবিতব্য, নৈতিকতার অনন্তসার এবং পার্থিব ও স্বর্গীয় জীবনের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
বাস্তবে অর্জুন হচ্ছে জীবন সংগ্রামের প্রতীক। শ্রীকৃষ্ণ সর্বশক্তিমান, পার্থিব রূপ পরিগ্রহ করে বা অবতার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ধরাধামে। শ্রীকৃষ্ণ দিব্যচক্ষু দান করলে অর্জুন দর্শন করলেন বিশ্বরূপ এবং বললেন, ‘হে জগতের প্রভু, বিশ্বেশ্বর, তোমার আদি, মধ্য ও অন্ত কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। তুমি অনন্ত বীর্যশালী, বাহুধারী, চন্দ্র-সূর্য তোমার চক্ষুদ্বয়, তোমার মুখদীপ্ত অগ্নির ন্যায়। তুমি নিজের তেজে জগৎকে তাপিত করেছ। তুমি স্বর্গ, মর্ত্য আর মধ্যবর্তী স্থল সর্বত্র ব্যাপিয়া বিরাজমান। তুমি বায়ু-যম-অগ্নি-বরুণ-চন্দ্র, প্রজাপতি-প্রপিতামহ, সকল দেবতার দেবতা তুমি। তোমাকে সম্মুখে, পশ্চাতে এবং সর্বদিকে প্রণাম করি।’ অর্জুন ভীত হলেন। ভগবান বললেন, কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে কী হবে সব আমি নির্ধারণ করে রেখেছি, তুমি উপলক্ষ মাত্র। কর্মে তোমার অধিকার, ফলে নয়। ফলদানের অধিকার স্বয়ং ভগবানের।
মানবজীবনের লক্ষ্য হলো ঈশ্বর লাভ, পরমাত্মার সঙ্গে মিলন। কৃষ্ণভক্তরা ভগবানকে দেখতে পায় বহুরূপে, বহুভাবে, সব জীবের মাঝে। কখনো শালগ্রাম শিলায়, কখনো সূর্যের কিরণে, কখনো সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে, আবার কখনো বিবিধ মর্ম্মর মূর্তিতে।
ঈশ্বর প্রাণের প্রিয় বস্তুটির মাঝে অবস্থান করেন, দুঃখীজনের অশ্রুর মধ্যে বিরাজ করেন। তাই স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়,
‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর,
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’
অনন্ত কোটি ব্রহ্মা-ের যিনি স্রষ্টা, পালনকর্তা এবং সংহারকর্তা, তিনিই মনুষ্যরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণরূপে। তিনি পরমাত্মা, পরমতেজ, যার আদি নেই, অন্ত নেই, তিনি সবার প্রভু। জন্মাষ্টমীর এ মহাযজ্ঞে সব ধর্মপ্রাণ মানুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধরাধামে অবতীর্ণ হওয়ার দিনটি উদযাপন করে ভক্তি, বিশ্বাস, প্রার্থনা এবং গীতাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে। সঙ্গে চলে আনন্দ সংগীত, নাটক ও নৃত্য।
ঢাকার জন্মাষ্টমী মিছিল ঐতিহাসিক। চলে আসছে অনেকদিন থেকে। বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণে, জঙ্গিবাদ নিরসনে, জন্মাষ্টমীর মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে সব মানুষের মহামিলনের মাঝে, সব ধরনের মতানৈক্য ও বিপরীত চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে। আসুন, এ শুভদিনটিকে আনন্দমুখর করে রাখি বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের মহামিলনের মাঝে, দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণ কামনায় প্রার্থনা করি ঘরে ঘরে।
লেখক : সাবেক সচিব ও উপদেষ্টা, শ্রী শ্রী গীতাসংঘ বাংলাদেশ।
/ এআর /