চিকিৎসাক্ষেত্রে নৈরাজ্য
হিমশিম খাচ্ছেন ইন্টার্নিরা : জ্যেষ্ঠরা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০৬:৩৮ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০৭:৫৭ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার
এমবিবিএস শেষ করে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে যুক্ত হন নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তোলার জন্য। তাদেরকে দক্ষ চিকিৎসক হিসাবে গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখার কথা হাসপাতালে অবস্থানরত জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের। সিনিয়র ডাক্তারদের দায়িত্ব হচ্ছে হাতে কলমে শিক্ষানবীশদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাঁদের থেকে পাওয়া জ্ঞান ও অর্জিত অভিজ্ঞতা নিয়ে মানবসেবায় কাজ করার কথা শিক্ষানবীশদের। নিয়মানুযায়ী এমন কথা থাকলেও বাস্তবে তার মিল খুবই কমই দেখা মিলছে মেডিক্যাল কলেজগুলোয়।
শিক্ষানবীশ এই চিকিৎসকরাই পর্যায়ক্রমে ২৪ ঘণ্টা রোগীর চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। বিধান অনুযায়ী যাদের কাছ থেকে হাতে-কলমে শিক্ষানবীশদের শিক্ষা নেওয়ার কথা, সেই জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রাইভেট প্রাকটিসে। শুধুমাত্র বাড়তি আয়ের আশায় এমন অনৈতিক কাজ করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে যায়, সকাল সাড়ে ৮ থেকে দুপুরে আড়াইটা-এই ছয় ঘন্টায় পর জ্যেষ্ঠ্য চিকিৎসকরা হাসপাতালে। অনেকেই নির্ধারিত সময়ের পর হাসপাতালে আসেন। আবার অনেকেই নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই হাসপাতালে ছাড়েন। ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজের কাজ নিয়ে। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন সভা সেমিনারের দোহাই দিয়ে ছুটিতে থাকেন সপ্তাহের অধিকাংশ দিন। এমতাবস্থায় রোগীদের সেবা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষানবীশ ও অবৈতনিক চিকিৎসকদের।
এখানেই শেষ নয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এমন অবহেলার কারণে অনেক সময় রোগীর সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। কমছে না স্বজনদের উৎকণ্ঠা ও হয়রানি। অনেক সময় চিকিৎসা সেবা মিলতেও দেরি হচ্ছে। সুচিকিৎসা না মিলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যামন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নেতৃত্বে সান্ধ্যাকালীন রাউন্ড চালুর নির্দেশ দিলেও তার দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। তবে অভিযোগ আছে। দুপরের পর একযোগে জোষ্ঠ্য চিকিৎসকরা বাড়তি আয়ের লোভে বেড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন প্রাইভেট প্র্যাকটিসে। গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক অথবা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা মিলছে তাদের।
এ সময় যত ঝুঁকিপূর্ণ রোগীই আসুক না কেন, তাদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হচ্ছে মেডিকেল অফিসার, অবৈতনিক ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের। খুব প্রয়োজন হলেও দেখা মিলছে না কোনো অধ্যাপক, সহযোগী বা সহকারী অধ্যাপকের। বিশেষ কোন দিবস বা ছুটির দিনে পরিস্থিতি হচ্ছে আরও খারাপ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ রাজধানীর বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ঘুরে এ অবস্থা দেখা গেছে।
শিক্ষানবিশ ও অবৈতনিক অন্তত ১০ জন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে তাদের শত শত রোগীর চাপ সামলাতে হয়। রোগীর কথা শুনতে হয়, তথ্য লিখতে হয়। পরদিন সকালে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক আসার পর তাকে রোগীর সার্বিক বিষয় জানানোর জন্য প্রয়োজনীয় নোট নিতে হয়। এর আগ পর্যন্ত রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়। এত দায়িত্ব পালন করলেও তাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় খুব কম। বছরে ছুটি মেলে মাত্র ১৫ দিন। মাসে মাত্র ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
এমন বেহাল অবস্থার কথা স্বীকারও করেছেন অনেক জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক। এবিষয় জানতে চাইলে চিকিৎসকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, শিক্ষানবীশ চিকিৎসকদের কাজের চাপ বেশি। তারা সরকারি চাকরি করেন না। তাদের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের কাছ থেকে হাতে-কলমে শিক্ষা নেওয়ার কথা। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে তারা কাজ করছেন পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। যদিও এ জন্য তাদের তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।
বাড়তি অর্থ আয়ের লোভে নিজের দায়িত্ব ফেরে জ্যেষ্ঠ্য চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ঝুঁকে এমন প্রশ্নের জবাবে বিএমএর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই মাহবুব একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণের প্রভাবকে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি হাসপাতাল সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরির পেছনে চিকিৎসকরা নিজেরাই দায়ী। জ্যেষ্ঠদের অনুসরণ করে নতুন চিকিৎসকরাও একই ধরনের চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের চর্চা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয় উল্লেখ করে তিনি।।
খোঁজ নিয়ে যায় গেছে, এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী, এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা এক বছরের জন্য হাসপাতালে শিক্ষানবীশ চিকিৎসক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেবেন। এর মধ্যে তারা ১১ মাস মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে, ১৫ দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করবেন। এ সময় তারা ছুটি পাবেন ১৫ দিন।
চিকিৎসকদের সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী, শিক্ষানবীশ সময়কাল শেষে চিকিৎসকরা রোগীর সমস্যা সঠিকভাবে অনুধাবন করে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানটির রেজিস্ট্রার ডা. জাহিদুল হক বাসুনিয়া বলেন, এমবিবিএস ও বিডিএস পাসের পর শিক্ষার্থীদের এক বছরের জন্য সাময়িক সনদ দেওয়া হয়। সফলভাবে শিক্ষানবিশকাল শেষ করার পর সাময়িক সনদ ফেরত নিয়ে পেশা চর্চার স্থায়ী সনদ দেওয়া হয়।
এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এবং বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কোনো লিখিত ও অলিখিত নির্দেশনা নেই। অনেক আগ থেকে এ নিয়মে হাসপাতালের কর্ম পরিচালিত হয়ে আসছে।
এই পদ্ধতি অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে ছুটির দিন বাদে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর হাসপাতালে অভ্যন্তরীণভাবে রোস্টার পদ্ধতিতে বাকি ১৮ ঘণ্টা রোগীর চিকিৎসা চলে।
এসময় ওয়ার্ডগুলো সংশ্নিষ্ট বিভাগের একজন সহকারী রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে থাকে। তার সহযোগী হিসেবে কয়েকজন মেডিকেল অফিসার কাজ করেন। আর হাতে-কলমে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিতে অবৈতনিক ও শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা উপস্থিত থাকেন। এই সময়ের মধ্যে কোনো রোগী কঠিন বিপর্যয়ে পড়লে সংশ্নিষ্টরা সহকারী রেজিস্ট্রারকে জানাবেন। তিনি কোনো সমাধান করতে না পারলে বিষয়টি পর্যায়ক্রমে রেজিস্ট্রার ও অধ্যাপককে জানানো হবে। তবে রাতে বিভাগীয় প্রধান ও ইউনিটের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক অবৈতনিক ও ইন্টার্নি চিকিৎসকদের নিয়ে রাউন্ড দেবেন। ঈদের আগে ও পরে সরজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়।
সরেজমিন পরিদর্শনে ঈদের আগে প্রায় তিন দিন রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যায়নি। ওইসব হাসপাতালে অবৈতনিক ও শিক্ষানবীশ চিকিৎসকদের চিকিৎসাসেবা দিতে দেখা গেছে। আবার কোনো কোনো হাসপাতালের ওয়ার্ডে কোনো চিকিৎসকই পাওয়া যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ঈদের ছুটির আগেই অনেক ওয়ার্ডে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ঈদের ছুটিতে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বর্তমান সরকার জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য চিকিৎসকদের আরও আন্তরিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে- তারা মানবসেবার ব্রত নিয়ে এই মহান পেশায় এসেছেন।
টিআর/ এআর