ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪,   চৈত্র ১৪ ১৪৩০

আমি সংখ্যা ভুলে যাই

আতাউল গণি সুমন

প্রকাশিত : ১১:১৫ পিএম, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

আতাউল গণি সুমন

আতাউল গণি সুমন

আমার কোন শৈশব ছিল না। থাকলেও আমার মনে পড়ে না। শৈশবের কোন সুখস্মৃতি আমার মনের কোণে ভেসে উঠে না। চারপাশ রাঙানো কোন মধুর স্মৃতি আমাকে আলোড়িত করে না। শৈশবে আমার কোন বন্ধু ছিল না। তবে ছিল এক রোমাঞ্চকর অজানা জগৎ। সে জগৎ ছিল সবুজ গাছ আর পাখপাখালিতে ভর্তি। চারপাশে শুধু সবুজ গাছ আর গাছ, পাখি আর পাখি। ভরদুপুরে গাছের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম, শুনতাম পাখির গান, হাজারো পাখির গান, তারাই ছিল আমার বন্ধু। আমি আনমনে হেঁটে বেড়াতাম এক বাগান থেকে অন্য বাগানে, হারিয়ে যেতাম সবুজে, সে যে কি এক অবর্ণনীয় স্বর্গীয় সুখ বলে বুঝানো যাবে না!

খুব রূপকথার গল্প পড়া হয়নি ছেলেবেলায়, হাতের কাছে পাইনি বলে, কিন্তু আমি ঘুরে বেড়াতাম ‌“অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড”-এর মতোই সবুজ ঘন বাগানে। খরগোশ অবশ্য ছিল না সেখানে। ছিল হাজারো পাখি, তাদের কিঁচিরমিঁচির ডাক, মা আর বাচ্চা পাখিদের উড়োউড়ি খেলা, শিমুল তুলা উড়তো বাতাসে, রক্তলাল শিমুল ফুল, বাতাসে ভেসে বেড়ানো নরম সাদা তুলো আর সবুজে ঢাকা চারপাশ। আমি তন্ময় হয়ে থাকতাম, হারিয়ে যেতাম অজানা অন্য এক জগতে, যেখানে আমি, রক্তলাল শিমুল ফুল, বাতাসে ভেসে বেড়ানো নরম সাদা তুলো, মা পাখি আর তার বাচ্চারা আর সবুজ বৃক্ষরাজি ছাড়া আর কেউ নেই। সবুজের বাইরের ওই জগৎ আমার নয়,আমিও কেউ নই ওই জগতের।

শৈশবের কোন সুখস্মৃতি আমার মনে পড়ে না, শুধু মনে পড়ে -নিবু নিবু আলোয়, অন্ধকার ঘরের কোণায়, যেখানে আমার শোবার খাট, পাশে তিন ভাইবোনের একমাত্র পড়ার টেবিল, খাট পেয়েছি বলেই আমার ছিল না কোন চেয়ার, খাটে বসলেই টেবিল, তখন পড়া আর পড়া, “আলস্য দোষের আকর”, “ইক্ষুরস অতি মিষ্ট”, “উর্ধ্বমুখে পথ চলিও না”, “গুরুজনকে কর নতি”।

শৈশবের একটা স্মৃতি কেবলই মনে পড়ে। বুলু স্যার-আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক, যিনি আমাদের ঘরে লজিং মাস্টার হিসেবে ছিলেন, আধবোলা যশোরের মানুষ, যত্ন করে পড়াতেন আমাকে -বাজার থেকে এক হালি ইলিশ মাছ কিনে আনলেন। মাছ ছাড়া ভাত খান না মা, ইলিশ হলে তো কথাই নেই। মাছ ভাজা হচ্ছে, হলুদ আর লবণ মাখানো ইলিশের টুকরো গরম তেলে পড়ার ‘চিড়বিড়ে’ শব্দের গতির সাথে বাড়ছে উচ্চস্বরে পড়ার গতিও,“আলস্য দোষের আকর”, “ইক্ষুরস অতি মিষ্ট”, “উর্ধ্বমুখে পথ চলিও না”, “গুরুজনকে কর নতি”।

মা বলতেন, “বাবা, ইশ্বরচন্দ্রের মতো হও, নদী পাড়ি দিয়ে অসুস্থ মাকে দেখতে এসেছেন।” আহারে! মাকে দেখতে কতদিন বাড়ি যেতে পারি না। আমার কেবলই মনে হতো বায়েজিদ বোস্তাামীর মতো পানির গ্লাস হাতে আমি সারারাত দাঁড়িয়ে আছি, মা কখন জাগবেন, পানি খাবেন। সবাই বলতো ইশ্বরচন্দ্র কত্তো মেধাবী, শুধু কয়েকটা মাইলপোষ্ট দেখেই এক থেকে একশ পর্যন্ত শিখে ফেলেছেন। আমার খুব হিংসে হতো, আমি পদ্মা বাজার থেকে রামগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়ার পথে বারবার শুধু মাইলপোস্টের দিকে তাকাতাম। মাইলপোস্ট দেখলে এখনো বিদ্যাসাগরের কথাই মনে পড়ে। আমি সংখ্যা ভুলে যাই।

মা কিন্তু বিদ্যাসাগরের মেধার কথাটা কখনো বলতেন না। হয়তো জানতেনও না। শুধু তার মাতৃভক্তির কথাটাই জানতেন। আমি কল্পনায় দেখতাম, বিদ্যাসাগর বাবার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছেন আর জিজ্ঞাসা করছেন, “বাবা, এটা কত?”, বাবা বলতেন, “এটা ১”, “বাবা,এটা কত?”, “এটা ৯”, বিদ্যাসাগর বলতেন, “বাবা, এটা ১ দশ ১, এগারো”, বাবা বলতেন, “এটা ৯ দশ ৯, নিরানব্বই”, বিদ্যাসাগর বলতেন, “বাবা, এটা দশ দশে ১০০।”

সবুজ বাগানের চারপাশেই ছিল চিকন সরু জলাশয় যাকে খাল বলা যাবে না। দাদী স্থানীয় কেউ বড়শিতে মাছ ধরছে, হঠাৎ জোরে টান, কত্ত বড় টাকি, “এ্যাই শব্দ করিস না, আরও আছে।” আমি আবার হারিয়ে যাই আমার সবুজে, পুকুর পাড়ে সবুজ গাছের সবুজ পাতার আড়ালে আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছে দুই হাত লম্বা চিকন সবুজ সাপ। আমি ভয় পেয়ে যাই, দৌড়ে আসি বাড়িতে। ঘুমের ঘোরে আমি এখনো সেই সবুজ সাপ দেখি। মাঝরাতের সিগারেট, পানি আমার তৃষ্ণা মেটায় না। সবুজ সাপের কালো শীতল চোখ আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়।

লেখক: উন্নয়ন কর্মী।

এসএইচ/