বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী উদ্ভাবন
২৫ টাকায় নির্ণয় হবে ক্যান্সার
তবিবুর রহমান
প্রকাশিত : ০৭:৫৬ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ০৭:০৭ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
প্রতিকী ছবি
দেশে অসংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে যে বিপুল সংখ্যক রোগী প্রতি বছর মারা যাচ্ছে, তার সিংহভাগই ক্যান্সারজনিত কারণে। বর্তমানে দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। বেশির ভাগ রোগীর ক্যান্সার শনাক্ত হয় রোগের শেষ পর্যায়ে।
সেটাও জানা সম্ভব হয় জটিল সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। ফলে শেষ সময় এসে ডাক্তারের কিছু করার থাকে না। এছাড়া বিশ্বে এখন পর্যন্ত এমন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি, যার মাধ্যমে আগে থেকেই ক্যান্সার শনাক্ত করা যায়।
তবে বিশ্ববাসীর জন্য সুসংবাদ নিয়ে এসেছে বাংলাদেশের এক দল গবেষক। তাঁদের গবেষণায় শুধু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই ক্যান্সার সশনাক্তকরণ করা যাবে। মাত্র ৮ ঘন্টায় ৫০০ টাকায় ক্যান্সার নির্ণয় করা যাবে। শুধু তাই না, পরীক্ষার করা জন্য গ্লাস ব্যবহার করা হয় সেটি চীন থেকে আসে এটা যদি আমাদের দেশে তৈরি করা যায়। তাহলে ক্যান্সার নির্ণয়ে খরচ হবে মাত্র ২৫ টাকা।
এই যুগান্তকারী উদ্ভাবনে সফলতা দেখিয়েছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষক দলের প্রধান হিসেবে কাজ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. ইয়াসমিন হক।
এবিষয় গবেষক দলের প্রধান ড. ইয়াসমিন হক একুশে টিভি অনলাইনকে জানান, মানুষের দেহে লেজার রশ্মি পাঠিয়ে শরীরের ক্যান্সার আছে কি-না সেটি জানা যাবে। তিনি বলেন, বর্তমানে ক্যান্সার শনাক্তে যে প্রচলিত পদ্ধতি রয়েছে সেটি বেশ খরুচে।
এখন অল্প খরচে ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব হবে। নন-লিনিয়ার অপটিক্স ব্যবহার করে বায়োমার্কার নির্ণয়’ শীর্ষক প্রকল্পের গবেষণা ফল হচ্ছে- নন-লিনিয়ার অপটিক্যাল ধর্ম ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগীর শরীরের তরল পদার্থ ব্যবহার করে ক্যান্সার নির্ণয়ের পদ্ধতি’ উদ্ভাবন।
তিনি বলেন, প্রচলিত প্রযুক্তিতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় এবং ৫ থেকে ৭দিন সময় লাগে ক্যান্সার শনাক্ত করতে। তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিতে মাত্র ৫০০টাকা ব্যয়ে ৮ ঘণ্টায় ক্যান্সার শনাক্ত করা সম্ভব। কারণ, বায়ো-কেমিকেল প্রক্রিয়ায় যে বাড়তি রিএজেন্ট ব্যবহার করতে হয়।
কিন্তু নতুন প্রযুক্তিতে তার কিছুর প্রয়োজন হয় না। নন-লিনিয়ার অপটিক্যাল ধর্ম ব্যবহার করে ক্যান্সার রোগীর শরীরের তরল পদার্থ ব্যবহার করে ক্যান্সার নির্ণয় সম্ভব। শুধু ক্যান্সার নয় এপদ্ধতির মাধ্যমে আরও অনেক কিছু নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
এই পদ্ধতি একজন ব্যক্তি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে এটা নির্ণয় করা যাবে। তবে কোন অংশ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে এটা কি জানা যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয় করা যাবে। এর পর ডাক্তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কি ক্যান্সার কোন স্থানে ক্যান্সার জানতে পারবে।
আমাদের দায়িত্ব হলো রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার নির্ণয় করতে পারবে। আগামী বছর আমাদের ডিভাইস বাজরে ছাড়তে পারবো বলে আশা ব্যক্ত করছি। এই ডিভাইস কিনতে খচর পড়বে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।
তিনি আরও জানান, নতুন উদ্ভাবনের পেটেন্টের আবেদন ইতোমধ্যে বাংলাদেশ এবং ইউএস পেটেন্ট অফিসে করা হয়েছে। এ পদ্ধতি এর আগে কখনোই কোনো দেশে ব্যবহৃত হয়নি।
আশা করা যায়, ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ের সম্পূর্ণ নতুন একটি পদ্ধতি হিসেবে এটি নতুন একটি দ্বার উন্মোচন করেছে। এরই মধ্যে এগবেষণার ফলের পেটেন্টের জন্য একযোগে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই গবেষণা মূলত ক্যান্সার নির্ণয়ের সহজ একটা পদ্ধতি। আমরা হেকেপের সহায়তায় এই ভিন্নধর্মী গবেষণা করেছি। হেকেপের দেশি-বিদেশি স্পেশালিস্টরা এ গবেষণা দেখার পরই তা ইউএসএ পেটেন্টের জন্য আবেদনের আগে কাউকে না জানানোর জন্য বলেন।
কারণ এ ধরনের গবেষণা বিশ্বে প্রথম। নিশ্চয়ই এ গবেষণার গুরুত্ব আছে বলেই তাঁরা পেটেন্টের জন্য আবেদন করতে বলেছেন। তবে এ বিষয়ে আরও অনেক উচ্চতর গবেষণা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, এ উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্যান্সার রোগাক্রান্ত রোগীদের রক্তে এমন কিছু একটা অনুসন্ধান করে বের করা সম্ভব হবে, যার নন-লিনিয়ার ধর্মটি ক্যান্সার রোগের সম্ভাব্যতার একটি ধারণা দেবে। প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে শুধু ক্যান্সার রোগাক্রান্ত রোগীদের রক্ত নয়, অন্য যেকোনো স্যাম্পলের নন-লিনিয়ার ধর্ম খুবই সহজে সূক্ষ্মভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হবে।
জানতে চাইলে ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদা আরজুমান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, বর্তমানে পার্টিকুলার ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়।
সেখানে বায়োপসির মতো পরীক্ষারও প্রয়োজন পড়ে। আর সাধারণত যখন কারো সন্দেহ হয় বা রোগের উপসর্গ দেখা দেয় তখনই মূলত রোগীরা আসে। এখন যদি নতুন কিছু আবিষ্কৃত হয়, তাহলে সেটা তো খুবই ভালো। আর এই আবিষ্কার বাংলাদেশের গবেষকরা করলে চিকিৎসাক্ষেত্রে আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাব। তবে এটা কাজ শুরু হতে আরও সময় লাগবে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ‘নন-লিনিয়ার অপটিকস ব্যবহার করে বায়োমার্কার নির্ণয়’ শীর্ষক প্রকল্পটি হেকেপের আওতায় সিপি-৪০৪৪ হিসেবে গৃহীত হয়। এ প্রকল্পের অংশ হিসেবে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে নন-লিনিয়ার বায়ো-অপটিকস রিসার্চ ল্যাবরেটরি নামে একটি নতুন ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা হয়।
এ ল্যাবরেটরিতে ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের রক্তের সিরামে শক্তিশালী লেজার রশ্মি পাঠিয়ে নন-লিনিয়ার ধর্মের সূচক পরিমাপ করার কাজ শুরু হয়েছে। ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ে বায়োকেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় যে বাড়তি রি-এজেন্ট ব্যবহার করতে হয়, শাবিপ্রবিতে উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতিতে তার কিছুরই প্রয়োজন হয় না।
২০১৫ সালের দিকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) এই নন-লিনিয়ার অপটিকস রিসার্চ গ্রুপটি গবেষণার ব্যাবহারিক দিক নিয়ে কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রুপটি হেকেপের উইন্ডো ফোরের আওতায় ইউনিভার্সিটি-ইন্ডাস্ট্রি সমন্বিত গবেষণার জন্য একটি উদ্ভাবনীমূলক পরিকল্পনা জমা দেয়।
পরিকল্পনাটি ছিল ক্যান্সার রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের নন-লিনিয়ার ধর্ম পরিমাপ করে ক্যান্সারের সম্ভাব্য উপস্থিতি ও অবস্থা চিহ্নিত করার একটি প্রক্রিয়া উদ্ভাবন। অর্থাৎ প্রচলিত বায়োকেমিক্যাল ক্যান্সার নির্দেশক বায়োমার্কারের পরিবর্তে একটি অপটিক্যাল বায়োমার্কার উদ্ভাবন করা।
টিআর/ এআর