চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে অত্যাধুনিক চালকল
প্রকাশিত : ০৮:৪৩ এএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
আম ও কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। কৃষি, শিল্প আর ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর ভর করেই ঘুরছে এখানকার অর্থনীতির চাকা। কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাওয়ায় চাঙ্গা হয়ে উঠছে জেলার অর্থনীতি। আমের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে অত্যাধুনিক চালকল। কৃষিভিত্তিক শিল্পটি গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে।
এক সময় এ জেলার অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ শিল্প ছিল কাঁসা পিতল। পরবর্তিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বোরো ধানের আবাদ। কয়েক বছরের মধ্যে জেলাটি উদ্বৃত্ত বোরো ধান উৎপাদনে সক্ষম হয়। এ পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, এর অধিকাংশই কৃষিভিত্তিক খাদ্য ও খদ্যজাত পণ্য উৎপাদনকারী। এর মধ্যে চালকলের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে এ জেলায় বৃহৎ শিল্প- ০৩ , মাঝারী শিল্প-১১ , ক্ষুদ্র শিল্প-৬৭৪ টি । খদ্যজাত পণ্য চাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নবাব অটো রাইস এন্ড ফিড মিলস, মেসার্স এরফান সুপার রাইস মিল ও রোকেয়া অটোমেটিক রাইস মিলস (প্রাঃ) এ তিনটি জেলার বৃহৎ শিল্প। জেলা প্রশাসকের কার্যলয় সুত্রে জানা গেছে, জেলায় মাঝারী শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১১টি তার মধ্যে ১০টি খাদ্যজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আর একটি জুট প্রডাক্ট । খাদ্য ও খাদ্যজাত পণ্য উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান ৩১০, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ ৫০, কাঠের ফার্নিচার ১০২, ‘স’ মিল ৩৪, স্টীল ফার্নিচার ৩৫, এ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরী ৫, বস্ত্র শিল্প ৩৫, প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং ২০, কেমিক্যাল ২, পোল্ট্রি ফার্ম ৫০ ও বিবিধ শিল্প রয়েছে ৩১ টি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন, জেলায় প্রথম অটো রাইস মিল ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তা তাইনুস আলী পৌরসভার নতুনহাট এলাকায় ‘সোনালী অটো’ নামে অটো রাইস মিল স্থাপন করেন। এরপর ১৮ বছরের ব্যবধানে এটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। তারা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে চালকলে বিনিয়োগ সব থেকে বেশি। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও তা প্রায় ছয় শ কোটি টাকার কাছাকাছি। কারণ প্রতিটি অটোমেটিক রাইস মিল তৈরিতে প্রায় ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা প্রয়োজন। চালকল মালিক সমিতির তথ্যমতে ছোট বড় মিলিয়ে ৩২ টি অটো চালকল রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। অটো মিলগুলো প্রতিদিন ছয় থেকে ১২ টন চাল উৎপাদন করছে। সুগন্ধি পোলাও চালের পাশাপাশি মিনিকেট, আটাশ, পাইজাম, স্বর্ণা, জিরাশাইল, গুটিস্বর্ণাসহ সব ধরনের চাল উৎপাদন করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত এরফান, বাসরী, সাগর, টি ইসলাম, নবাব, হক, মুঞ্জুর ও পলাশ ব্র্যান্ডের চাল বাংলাদেশের বাজারে চাহিদার শীর্ষে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে উৎপাদিত অন্যান্য চাল ১০ ভাগ ও পোলাও এর চাল দেশের প্রায় ৫০ ভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে। বর্তমানে দেশের অন্যতম খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী এরফান মিল রয়েছে এ জেলায়। চাল শিল্প একদিকে অবদান রাখছে জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানেও ভূমিকা রাখছে। পৌরসভার অদূরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-আমনুরা সড়কের দুই ধারে বরেন্দ্রভূমিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য অত্যাধুনিক চালকল। নির্জন এ অঞ্চলটি যে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এত বড় ভূমিকা রাখবে, তা হয়তো ২০০০ সালের আগে কেউ চিন্তাও করেনি।
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরাতনগুলো সম্প্রসারণ ও নতুনভাবে গড়ে উঠছে একাধিক রাইস মিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার লক্ষ্মীপুর এলাকায় নির্মাণাধীন রয়েছে সাতটি অটো রাইস মিল। এই মিলগুলো নির্মাণ শেষ হলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত প্রায় ৩ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং প্রতিদিন প্রায় ১৫০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন সম্ভব।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আয়তন ১ হাজার ৭০২ দশমিক ৫৬ বর্গকিলোমিটার। সেখানে মোট জমির পরিমাণ এক লাখ ৭০ হাজার ৪৮৩ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদী জমির পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৯৮ হেক্টর। সিংহভাগ আবাদী জমিতে ধান উৎপাদন হয়। হিসেব মতে জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, ‘শুধু আমার মিল থেকেই প্রতিদিন ১০০ টন পোলাও এর ও অন্যান্য ৩৩০ টন চাল উৎপাদন হয়।’ অল্প সময়ের ব্যবধানে এ শিল্পটি জেলার গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত এসব অত্যাধুনিক চালকলে রফতানিযোগ্য মানসম্মত চাল উৎপাদন করা হয়। তিনি আরও জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত চাল বিদেশে রপ্তানির সুযোগ পেলে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত চাল বিদেশেও সুনাম অর্জন করবে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক ওবাইদুল ইসলাম পাঠান বলেন, ‘চাল শিল্প জেলার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক বিবেচনায় জেলার অন্যতম সমৃদ্ধ শিল্প এটি। এ খাতের কারণে জেলায় প্রচুর আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সহযোগী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।
আরকে//