যে চিঠিতে বদলে গেলে তরুণ উদ্যেক্তার জীবন
প্রকাশিত : ১১:১৮ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শুক্রবার | আপডেট: ০১:৩৬ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার
চিঠি লিখছি। আসে পোস্টবাক্সভর্তি উত্তর। সঙ্গে কয়েক পদে পণ্যের ক্যাটালগ। কোনোটা জার্মানি, কোনোটা ফ্রান্স, কোনোটা ইতালি। কোনোটা-বা সিঙ্গাপুর থেকে। কিছু কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। তারপরও চেষ্টা করি উত্তর দেওয়ার জন্য। সব চিঠির উত্তর দিতে। একদিন ফ্যাক্স অফিস থেকে ফোন এলো জানালো একটা ফ্যাক্স এসেছে। কাজী আইয়ুবকে পাঠিয়ে সংগ্রহ করে দেখি, এক মার্কিন কোম্পানির সিঙ্গাপুর লেখা চিঠির থেকে পাঠানো ফ্যাক্স। বিয়াট্রিস ফুড (স) প্রাইভেট লিমিটেড। আমার লেখা চিঠির উত্তর। বাংলাদেশে তাদের প্রোডাক্টস তথা মিডোগোল্ড ব্রান্ড কন ডেন্সডন্সেড মিল্ক, মিল্ক পাউডার, বাটার অয়েল বাজারজাতকরণে আমাদের এজেন্ট নিয়োগ করতে চায়।
ফ্যাক্স চিঠির গুরুত্ব বুঝতে ছুটে গেলাম বড় ভাইয়ের কাছে। চিঠিটা পড়া পুরো শেষ না করেই ফোন করলেন দেওয়ানজী স্টোরের ঝুলন দাদাকে। দেওয়ানজী স্টোর, রিয়াজউদ্দীন বাজারের সেই সময়ের নাম করে মিল্ক ফুডস ডিলার। আমাদের একই গ্রামের বিখ্যাত দেওয়ানজী পরিবারের প্রতিষ্ঠান।
ফ্যাক্সের কপিটা নিয়ে গেলাম তার কাছে। দিখিয়ে বিস্তারিত বলেতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। তবে শর্ত একটা দেওয়ানজী স্টোর ছাড়া অন্য কাউকে মিডো ব্রান্ড দেয়া যাবে না। আমিও কথা দিলাম, তাই। অফিস ফিরে উত্তরটা ফ্যাক্স মাধ্যমে পাঠিয়ে দিলাম।
স্পষ্ট করে লিখলাম: ডিয়ার মিস্টার নিও, ইউ আর রেডি টু ওয়ার্কস অ্যজ ইওর এক্সক্লুসিভ এজেন্ট ফর প্রমোটিং দ্য সেলস অফ ইওর। মিডোগোল্ড সুইডেন্ড কনডেন্সপ মিল্ক হোল মিল্ক পাউডার অ্যান্ড পিওর বাটার অয়েল…।
ফ্যাক্স পাঠিয়ে অফিস ফিরতেই পেলাম ওভারসিস কল। নিও স্পিকিং ফ্রম বিয়াট্রিস ফুডস,সিঙ্গাপুর। জোরে গলা খাঁকি দিয়ে বললাম, ইয়েস স্যায়েত নুরুল স্পিকিং…। অপর প্রান্ত থেকে ভদ্রলোক জানতে চাইলেন আমি সিঙ্গাপুর যেতে পারবো কিনা। একটু চমকে উঠলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম ইয়েস আই ক্যান.. পাসপোর্টটা কেনো জানি আহেই বানিয়ে রেখেছিলাম। ভিসা প্রসিসিং টিকেট কাটা, বিসিসিআই ব্যাস্কে গিয়ে ট্রাভেলার্স চেক তৈরি করে একদিন সত্যি সত্যি সিঙ্গাপুরের উদেশে রওনা দিলাম। অজানা পথ অজানা ভাষা, কোথায় যাবো কি করবো, বুঝে উছতে পারছিলাম না বলে ভাবীর ছোটভাই সেলিম ভাই। আর ঝুলন দাদাকে সাথে নিলাম। খোরে সিঙ্গাপুরে অবতরণ করলাম। এয়ার পোর্ট থেকে নেমেই দেখি, একজন বয়স্ক চীনালোক আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। পরিচয় দিতেই হাতে বাড়িয়ে বললেন, আই অ্যাম নিও! আমিও বললাম স্যায়েস নুরুল…।
গাড়িতে উছে সোজা হোটেল। ১১ টায় দিকে নিও সাহেব এসে নিয়ে গেলেন জুরং এলকায় ফ্যাস্টরি লাগোয়া অফিসে। টুকতেই দেখি। আমার নাম লেখা বোর্ড। সুবহানাল্লাহ…। টুকে সোজা মিটিং রুমে। আমাদের অপেক্ষা ছিলেন। বয়স্ক এক ভদ্রলোক। চেহারা রাশভাবি। হাত বাড়িয়ে বললেন,। আমি রবার্ট জেনাবেল ম্যানেজার,বিয়াচ্রিস ফুডস! পরিয়চ পর্ব শেষে ভদ্রলোক চার পৃষ্ঠা ইংরেজীতে লেখা অ্যাগ্রিমেন্ট কপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, স্যয়েদ ইউ জাস্ট গো থ্রো দিজ কনট্রক্ট। আই অ্যাম কামিং হেয়ার ইন হাফ আওয়ার। ভদ্রলোক চলে গেলেন। আমি সেলিম ভাইকে নিয়ে অ্যাগ্রিমেন্টটা পড়ার এবয় বুঝার চেষ্টা করছি। সঙ্গে গ্লাস ভার্তি চায়নিজ চায়ে দিচ্ছি চুমুক। ঠিক আধ ঘণ্টা পর রবার্ট সাবেব ফিরে এসেই বললেন, জেন্টম্যান, আর ইউ ওকে ? ক্যান ইউ সাইন দ্য অ্যাগ্রিমেন্ট ? আমি সেলিম ভাইয়ের মুখে দিকে তাকিয়ে বললাম, ইয়েস ইউ ক্যান…..।
অ্যাগ্রিমেন্ট সাইনড গয়ে গেলে।
দুপুরের খাবার পালা। আমাদের নিয়ে আসা হলো সিঙ্গাপুর বিখ্যাত ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কমলাভিলা বানান লিফে। পুরো খাবারটাই কলাপাতায় সাজানো। খাবার শেষে এবার বিদায়ের পালা। আমার নিজের ইংরেজি নিয়ে আমি সবসময় নার্ভাস ছিলাম। কেনো জানি রবার্ট সাহেবকে বলেই ফেলাম সরি মি.রবার্ট মাই ইংলিশ ইজ নক গুড এনাফ। ভদ্রলোক আমার পিঠ থাপড়িয়ে ইংরেজিতে যা বললেন, তার অর্থ হচ্ছে আমি আমার ভাষা বাংলাটা ভালো শিখতে-পড়াতে এবং বলতে পারি না। ইংরেজিতে আমার দখল না থাকলেও কিছু আসে যায় না। এত বড় অ্যগ্রিমেন্ট সাইন করে যতটা খুশি হয়েছি। তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি রবার্ট সাহেবের ওই কথা শুনে !
জীবনে অনেক বিজনেস মিটিং অনেক অ্যগ্রিমেন্ট অনেক নেগোশিয়েশন, অনেক সেমিনার-সিস্পোজিয়ামে ইংরেজিতে কথা বলেছি। কিন্তু কোনো দিনই রবার্ট সাহেবের কথা ভুলিনি। কখনও ভাবিনি আমার ইংরেজি জ্ঞানের স্বল্পতা নিয়ে। ভেবেছি, কী বলতে চেয়েছি। সেটি ঠিক মতো বুছতে সক্ষম হয়েছি কিনা সেটাই বড় কথা।
লেখক: সৈয়দ নুরুল ইসলাম, চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী (ওয়েল গ্রুপ অব)।
চলবে-
টিআর/ এসএইচ/