বিবিসির বিশ্লেষণ
সেনাবাহিনীর পুতুল নাকি ইমরান খান?
প্রকাশিত : ১০:৩৭ এএম, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১১:১৭ এএম, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার
৩০শে আগষ্ট, ২০১৮। পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গেছেন রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দফতরে। সেনা প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বজওয়ার সঙ্গে তার প্রথম বৈঠক। সঙ্গে আছেন ইমরান খানের মন্ত্রিপরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রী।
বৈঠক শুরু হওয়ার পর সেটি যেন আর শেষই হতে চাইছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। আট ঘণ্টারও বেশি সময় পরে সেনা সদর দফতর থেকে বেরুলেন প্রধানমন্ত্রী।
সেনা প্রধানের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই এ রকম দীর্ঘ বৈঠক ইমরান খান সম্পর্কে সেই বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ণ যেন আবারও সামনে নিয়ে আসল। ইমরান খান আসলে কাদের লোক? সেনাবাহিনীই কি তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে?
এই ঘটনার কয়েকদিন পর খ্যাতিমান পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর সাক্ষাৎ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে। তারা সে দিন দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটিয়েছেন। কথা বলেছেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে। সেখানে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি সরাসরি জানতে চেয়েছিলেন, কী এত কথা হল সেনা প্রধানের সঙ্গে।
‘আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনি আট ঘণ্টার বেশি সেখানে ছিলেন। কী ঘটেছিল সেখানে? উনি আমাকে বলেছিলেন, আমরা সব নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে কথা বলেছি। প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা তখন তার সঙ্গে ছিলেন। তিনি আত্মবিশ্বাসী যে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বেসামরিক সরকারই এখন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতি এবং পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করবে।’
বিবিসিকে দেওয়া এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে হামিদ মীর নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্পর্কে তার নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। অনেকে তাকে ইমরান খানের প্রতি সহানুভুতিশীল বলে মনে করেন। তবে হামিদ মীর বলছেন, তিনি আসলে এখনই নতুন সরকার সম্পর্কে কোন অভিমত দিতে চান না। তিনি বরং কয়েকটা মাস অপেক্ষা করতে চান, ইমরান খানকে কিছুটা সময় দিতে চান।
প্রধানমন্ত্রী বনাম সেনাপ্রধান
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা। আর দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছে আসলে সেনা প্রধান। এমন একটি কথা পাকিস্তানে প্রচলিত আছে।
এটাও বলা হয়, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতি আর প্রতিরক্ষা নীতি ঠিক হয় সেনা সদর দফতরে, সেখানে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর কোনও এখতিয়ারই নেই। কাজেই ইমরান খান যে বলছেন, তার সরকারই পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নীতি আর পররাষ্ট্র নীতি ঠিক করবে, সেটা কি বিশ্বাসযোগ্য? পাকিস্তানের রাজনীতির যারা ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, এ নিয়ে সংশয় আছে তাদের মধ্যে।
‘পাকিস্তানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। যখনই পাকিস্তানে কোন বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, তাদেরকে একটা আপোস বা সমঝোতা করতে হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। এই আপোস-রফা রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত ক্ষমতায় গিয়ে করেন। কিন্তু এখন যেটা হয়েছে তা হলো, ইমরান খান ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই এই আপোস-রফা করে ফেলেছেন’, বলছেন যুক্তরাষ্ট্রর ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স এন্ড গভর্নমেন্ট বিভাগের ডিসটিংগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ।
এক কালের ক্রিকেট সুপারস্টার ইমরান খান যে একদিন একটি পরমাণু শক্তিধর দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাল ধরবেন, তা বছর দশক আগেও হয়ত অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইমরান খান এবং তার দল তেহরিক ই ইনসাফ পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ভূমিকম্প ঘটিয়ে দিয়েছেন, তা চমকে দিয়েছে অনেককে।
তৃতীয় শক্তির উত্থান?
পাকিস্তানের রাজনীতিতে পিপিপি এবং মুসলিম লীগ, ভুট্টো এবং শরিফ পরিবারের যে দীর্ঘদিনের আধিপত্য, সেটার অবসান ঘটিয়ে কি তিনি এক নতুন যুগের সূচনা করলেন?
আলী রীয়াজ বলছেন, আপাত দৃষ্টিতে বড় দুটি দলের প্রাধান্য খর্ব করে ইমরান খানের সাফল্য তৃতীয় এক শক্তির উত্থান বলে মনে হলেও, পাকিস্তানের রাজনীতির আসল চাবি-কাঠি এখনও আসলে সেনাবাহিনীর হাতেই।
‘ইমরান খান আসলে পপুলিস্ট রেটোরিক বা লোকরঞ্জনবাদী কথাবার্তাকে পুঁজি করতে পেরেছেন। কিন্তু এটাকে পুঁজি করাটাই যথেষ্ট ছিল না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তার সেনাবাহিনীর সঙ্গে একটা সমঝোতার দরকার ছিল। সেটাও তিনি করে ফেলতে পেরেছেন। আর সেটা করতে পেরেছেন বলেই তিনি ক্ষমতায় যেতে পেরেছেন।’
সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের এই আতাতের অভিযোগ আসলে কতটা সত্য? জি নিউজ নেটওয়ার্ক বা জিএনএন এর প্রেসিডেন্ট হামিদ মীর বলছেন, পাকিস্তানে কোন নির্বাচিত সরকার সম্পর্কে এ রকম অভিযোগ এবারই প্রথম নয়।
‘দেখুন, যখন নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় আসেন, তখন একই কথা তার সম্পর্কেও বলা হয়েছিল। তখন অভিযোগ করা হয়েছিল সেসময়কার সেনা প্রধান জেনারেল কায়ানি তাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছেন। যখনই নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় এসেছেন, তখনই বলা হয়েছে, সেনাবাহিনী তাকে সাহায্য করেছেন। এখন ইমরান খান সম্পর্কেও একই কথা বলা হচ্ছে । সেনাবাহিনী তাকে সাহায্য করেছে কি করেনি, তার কোন প্রমান আমার কাছে নেই। কিন্তু আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী তাকে সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে, কারণ তিনিই এখন প্রধানমন্ত্রী। আর কেবল সেনাবাহিনী নয়, বিচার বিভাগও তাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে।’
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
ক্ষমতায় আসার পরপরই ইমরান খানের সরকারের জন্য একটি বড় ধাক্কা এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য তাদের প্রায় ত্রিশ কোটি ডলারের সামরিক সাহায্য বাতিল করেছে। এটি ঘটলো এমন এক সময় যখন কিনা, পাকিস্তান রয়েছে এক চরম অর্থনৈতিক সংকটে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করছেন, এটি ইমরান খানের সরকারের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করতে পারে।
‘পাকিস্তানের এখন যত বৈদেশিক ঋণ, তার ৩৩ শতাংশের বেশি চীনের কাছে। মাত্র ৭ শতাংশ হচ্ছে আইএমএফের কাছে। ঋণের দায়ে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচতে পাকিস্তানকে ১২ বিলিয়ন ডলারের আবেদন নিয়ে খুব শীঘ্রই আইএমএফের কাছে যেতে হবে। আইএমএফ কিন্তু তখন শর্ত দেবে, চীনের কাছ থেকে যে সব বিনিয়োগ পাকিস্তান নিয়েছে, সেগুলোতে স্বচ্ছতা আনার জন্য। আমার মনে হয় না, ইমরান খান সেই কাজ করতে পারবেন।’
চীন পাকিস্তানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সামরিক মিত্রদের একজন, এখন আইএমএফের দাবি মানতে গেলে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন সৃষ্টি হওয়ার আশংকা আছে বলে মনে করেন তিনি।
এ রকম তীব্র এক অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ইমরান খান তার যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, সেটা আসলে কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন, তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।
‘অর্থনৈতিক সংকট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জন্য হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা তিনি বলেছেন, সেটা পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় প্রায় অসম্ভব।’
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচিত সরকারগুলো বার বার সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। আর এর পরিণামে আজ পর্যন্ত কোন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী তার পূর্ণ মেয়াদে সরকার পরিচালনা করতে পারেননি। সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের যত সুসম্পর্কই থাক, সেটা যে টিকবে, তার নিশ্চয়তা তাহলে কতখানি। পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর মনে করছেন ইমরান খান এরকম বিরোধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
‘আমার মনে হয় না ইমরান খান নওয়াজ শরিফের পদাংক অনুসরণ করবেন। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করবেন। যদি সেনাবাহিনী এবং বিচার বিভাগ তাকে সমস্যা মোকাবেলায় সাহায্য করে, তাহলে কেন তিনি তাদের সঙ্গে লড়াই করতে যাবেন। আমি কোন সমস্যা এখানে দেখছি না।’
তবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, সেনাবাহিনী এবং ইমরান খানের সমঝোতা কতদিন টিকবে সেটা অনেকখানি নির্ভর করবে সন্ত্রাসবাদ এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা কতদিন একমত থাকতে পারেন তার ওপর।
সূত্র: বিবিসি
একে//