ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৮ ১৪৩১

আট মাস বিনা বেতনে পড়াচ্ছেন পাঁচ সহস্রাধিক এসিটি শিক্ষক

তবিবুর রহমান

প্রকাশিত : ০৬:২৮ পিএম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার | আপডেট: ১০:৩১ এএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

দুর্গম এলাকার শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও মানসস্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন `টিচিং কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট` (টিকিউআই) প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো সরকার। এ প্রকল্পের অধীনে ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে অভিজ্ঞ ৫ হাজার ২০০ অতিরিক্ত শিক্ষক (এসিটি) নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। চুক্তি ছিলো মেয়াদ শেষ হলে নতুন প্রকল্প আসলে আবার তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে।

চুক্তির শর্ত ও মৌখিক নির্দেশে বিনা বেতনে ৮ মাস বিনা বেতনে পাঠদান করছেন এসব শিক্ষকরা। ফলে গত ঈদে বেতন-বোসান কোনো কিছুই জুটেনি তাদের ভাগ্যে। শুধু তাই নয়, নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির পরিকল্পনা থাকলেও পাঠদানে দক্ষ এই শিক্ষকদের নেওয়ার পরিকল্পনা নেই সংশ্লিষ্টদেরদের। ফলে চরম হতাশায় ভোগছেন পাঁচ সহস্রাধিক শিক্ষক। এক প্রকার মানবেতার জীবন যাপন করছেন মানুষ গড়ার কারিগররা।

শিক্ষকদের অভিযোগ, নিয়োগ-বাণিজ্য করার জন্যই নতুন নিয়োগ দিতে চান প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা। তাদের দাবি দীর্ঘ দিন ধরে তার শিক্ষকতা করে দক্ষতা অর্জন করছে।তাদের কারণেই দুর্গম, প্রত্যন্ত গ্রামের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও এখন অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল করছে। এখন তাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত। বলা হচ্ছে নতুন প্রকল্পে অন্তর্ভূক্তির জন্য তাঁদের আবার পরীক্ষা নেওয়া হবে। একবার নিয়োগ পরীক্ষা উতরিয়ে চাকরি নিশ্চিত করে বছর পাঁচেক সফলতার সঙ্গে পাঠদান করেও এখন আবার নিয়োগ পরীক্ষা বসতে হবে তাদেরকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দেশের দুর্গম এলাকায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিষয়ভিত্তিক পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক সংকট রয়েছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক থাকলেও তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীরা স্কুলের নিজস্ব বিভিন্ন পরীক্ষাসহ পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফল করতে পারছিল না। মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সরকার সেকায়েপ নামে একটি প্রকল্প চালু করবে।

বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে প্রকল্পটি চালু করা হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় তিন হাজার চারশ` ৮০ কোটি টাকা।

সেকায়েপ প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের অতি দুর্গম ৬৪টি উপজেলার দুই হাজার ১১টি স্কুলে গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান বিষয়ে প্রায় ছয় হাজার অতিরিক্ত শিক্ষক (এসিটি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ গত বছরের ৩১ জুলাই প্রকল্প শেষ হওয়া পর্যন্ত পাঁচ হাজার ১৮৭ জন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন।

২০১৫ সালের মার্চ মাসে শিক্ষকরা স্কুলে পাঠদান শুরু করেন। যাদের স্নাতকে প্রাপ্ত নম্বর ৫০ শতাংশের বেশি ছিল, কেবল তাদেরই আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। যাচাই-বাছাই করে সর্বোচ্চ যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শেষ হওয়া প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, শুরুতে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়াসহ শিক্ষকদের মাসিক বেতন ছিল ১৪ হাজার টাকা। জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী সর্বশেষ ২২ হাজার ২০০ থেকে ২৭ হাজার ৬০০ টাকা পর্যন্ত এই শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়।

প্রকল্প-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য উপজেলা পর্যায়ে এসব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠদান করছেন।

নিয়মিত ক্লাসের বাইরে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের মাসে অন্তত ১৬টি অতিরিক্ত ক্লাস নিয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীদের গণিত ও ইংরেজিভীতি কমেছে। এছাড়া বিষয়ভিত্তিক মান এবং প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি ও ঝরে পড়া কমেছে। অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ায় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়া ও কোচিং করার প্রবণতা কমেছে।

পাবলিক পরীক্ষায় প্রকল্পভুক্ত প্রায় সব স্কুলেরই শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পাঠাগার স্থাপন, মেধাবৃত্তিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এ প্রকল্প থেকে দেওয়া হয়। এসব সুবিধা নিয়ে পিছিয়ে পড়া এলাকার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেছে। কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন শিক্ষকরা।

এ বিষয় জানতে চাইলে মাধ্যমিকে অতিরিক্ত শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. মামুন হোসেন একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন,  প্রকল্পে মেয়াদ হওয়ার পরেও শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেই মৌখিকভাবে তাদের ক্লাস চালিয়ে নিতে বলা হয়। আবার তাদের এমপিওভুক্ত করারও আশ্বাস দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, এখন নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশায় পতিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা জানিয়ে দিয়েছেন। স্কুল না থাকলে তাদের সন্তানদের পড়াবেন না।

একাধিক এসিটি শিক্ষক অভিযোগ করেন, শুধুমাত্র নিয়োগ-বাণিজ্যের কারণে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একপক্ষ চাচ্ছেন আগের শিক্ষক দিয়েই পাঠদান চালাতে অন্যপক্ষ চাচ্ছেন নতুন করে আবার নিয়োগ দিতে। তারা আরও জানান, নিয়োগের প্রথম বছর শুধু বেতন বেড়েছে। তারপর আর বাড়েনি। প্রকল্পের মেয়াদ যত শেষ হতে থাকে, সুযোগ-সুবিধা ততই কমছিল। নতুন করে এমপিওভুক্তি করার ব্যাপারে তারা বলেন, এমপিওভুক্ত করা হলে তাদের পাঁচ হাজার শিক্ষকের মধ্যে অন্তত তিন হাজারই নীতিমালার কারণে বাদ পড়বেন। তাহলে এতে তাদের কী লাভ হবে? শিক্ষকদের চাওয়া, তাদের নতুন প্রকল্পে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করা হোক।

একাধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, সেকায়েপ প্রকল্পের একটি সফল উদ্যোগের মধ্যে ছিল এসিটি শিক্ষক নিয়োগ। শিক্ষার্থীরা খুবই উপকৃত হয়েছে। এসিটি শিক্ষকরা অভাবনীয় ভূমিকা রেখেছেন। তারা ভালো মানের দক্ষ শিক্ষক। তাদের পাঠদানের কারণে শিক্ষার্থীদের কোচিং ও প্রাইভেট নির্ভরতা অনেক কমেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ এসিটি শিক্ষক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কৌশিক চন্দ্র বর্মণ একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতাভুক্ত শিক্ষকদের অন্য প্রকল্পে স্থানান্তর বা স্থায়ী করা হয়নি। যদিও সেকায়েপের প্রকল্প ম্যানুয়ালে স্পষ্ট লেখা আছে, জনবল স্থায়ী বা পরবর্তী প্রকল্পে স্থানান্তর হবে। প্রকল্প ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মৌখিক আশ্বাস ও ২০ লাখ শিক্ষার্থীর কথা ভেবে আট মাস ধরে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তিনি বলেন, নতুন নিয়োগের প্রস্তাব ৫ হাজার ২০০ শিক্ষক মানতে রাজি নন।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহাবুবুর রহমান একুশে টিভি অনলাইনকে বলেন, এসিটি শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার সরকারি নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। সেই সিদ্ধান্তে তারা এখনও বহাল আছেন।

 টিআর/ এআর