মানব হিতৈষী ডা. আমজাদ হোসেনের ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ
সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা
প্রকাশিত : ০৯:৫৭ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার
পাকিস্তান সরকারের বাধা দমিয়ে প্রথম শিল্প কল কারখানা স্থাপনের উদ্যোক্তা ছিলেন ডা. মীর আমজাদ হোসেন। বাঙালিরা যাতে ব্যবসায়ীকভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে নিজেদের চাহিদা পুরণ করে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের পন্যের প্রসার না করতে পারে পাকিস্তান সরকারের এমন বাধা দমিয়ে এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের এই ক্যাপ্টেন কর্মকর্তা ২ বছর পরই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুল লক্ষ্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করে অভুতপুর্ব সফলতা অর্জন করার পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যতম শিল্প উদ্যোক্তা, শিক্ষা, চিকিৎসা বিস্তার এবং সামাজিক অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ভুমিকা রেখেছেন। আজ ১১ সেপ্টেম্বর তার ৬ষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী।
জানা যায়, ১৯২৫ সালের ১ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামের মুসলিম পরিবারে জন্ম মীর মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের। তিনি খাদ্য রসিক হওয়ায় সুস্বাদু খাবার পছন্দ হলেও পারিবারিক দরিদ্রতার কারণে তা সম্ভব হত না। মিতাহারের ফলে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হয়েও ৮৭ বছর পর্যন্ত সুস্থ অবস্থায় বেঁচে ছিলেন। যা সম্ভব হয়েছিল তার সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন ও খাদ্যাভ্যাসের জন্য। এ জন্য তার পীর এবং শ্বশুর হযরত খাজা শাহ সুফী মোহাম্মদ ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ)-এর নসিয়ত ও স্বল্পহার তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
এলাকার স্থলপাকড়াশী ইন্সটিটিউট থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করে ১৯৪৮ সালে ঐহিত্যবাহী কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবি (বর্তমানে এমবিবিএস) পাশ করে ১৯৫১ সালে পাকিস্তানী মেডিকেল কোরে ক্যাপ্টেন পদে যোগ দিয়ে ১৯৫৩ সালে এ চাকরি ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রাম দিয়ে সুতার রং ও কেমিক্যাল আমদানী ব্যবসা শুরু করেন। তদানীন্তন পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালী হিসেবে প্রথম ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে সুতার রং আমদানী করার জন্য এলসি খোলেন। যা দেশের তাঁত শিল্প সমৃদ্ধে বিরাট ভুমিকা পালন করে। এরপর পাটের ব্যবসা ও তা বিদেশ রফতানি, তাঁত কারখানা, ঢেউটিন, ওষুধের কাচামাল, কোরোসিন তেল আমদানী ব্যবসায় দক্ষতা ও দুরদর্শিতায় তার সফলতার ব্যাপক প্রসার ঘঠে। পুর্ব পাকিস্তানে দেশে প্রথম বারের মত ১৯৫৮ সালে টেক্সটাইল মিল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে করাচিতে শিল্প মন্ত্রনালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু অনুমতি না দিয়ে বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হবেনা বলে তাকে ছাফ জানিয়ে দেয়া হয়। তখন হতাশ হয়ে ফিরলেও তিনি দমে জাননি। পরে তখনকার পুর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর মোনেম খান ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারর্দীর সঙ্গে দেখা করে অনুমতি আদায় করে নেন। তবে পাক শিল্প মন্ত্রনালয় শর্ত জুড়ে দেন ঢাকায় না করে ৭৫ ভাগ বিহারী অধ্যুষিত পাবনার ঈশ্বরদীতে করার জন্য। নাছরবান্দা আমজাদ হোসেন এ শর্ত মেনে বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানীদের মনোভাব ভুল প্রমাণ করে অনুন্নত ঈশ্বরদীতে নানা প্রতিকুলতা মেনে জাপান থেকে মেশিনারিজ এনে চালু করেন আলহাজ টেক্সটাইল মিল। ১২ হাজার স্পনডলের এ মিলে ৫ শতাধিক মানুষের তখন কাজের সুযোগ হয়। এখান থেকে দেশের তাঁত শিল্পে সুতার চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হতো। শুরু হয় কাপড় উৎপাদনও। এই সাফল্য পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বাঙালিদের প্রতি তাদের কূদৃষ্টির মনোভাব কতটা ভুল। এরপর চট্টগ্রামের ক্যাপোক মিল, ১৯৬৭ সালে জামালপুরের সরিসাবাড়িতে আলহাজ জুট মিল, ১৯৮২ সালে ড্রাগ ইন্টা. লিমিটেড ওষুধ কোম্পানি, ১৯৯৪ সালে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিষ্ঠান এটিআই, এটিআই সিরামিকসহ বিভিন্ন ভারী শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন। পরে ভারতের শিলিগুড়ি ও কুচবিহারে চা শিল্প সফল হলে এপারেও সম্ভব, এমন ধারণা নিয়ে পঞ্চগড়ে এমএম টি এস্টেট লিমিটেড সুবিশাল চায়ের বাগান গড়ে তোলেন। তিনি টানা ৩ বার বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় বাংলাদেশ টেক্সটাইল এ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রায়ত্ব অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রুপান্তর করেন। দেশের শ্রেষ্ঠ করদাতা এবং ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি সিআইপি মনোনিত হয়েছেন। মানুষের দৌড় গোড়ায় বিশ্বের আধুনিক চিকিৎসা সেবা ও শিক্ষার বিস্তার কল্পে খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) কে উৎস্বর্গ করে ২০০৩ সালে এনায়েতপুরে দেড়শ একর জায়গায় প্রায় ১২শ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৮৬ বেডের দেশের বৃহৎ বিশ্বমানের অলাভজনক খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতাল, খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুছ আলী নার্সিং কলেজসহ বেশ কয়েকটি সেবা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। যা দেশ ও জনগনের জন্য সেবামূলক অলাভজনক ট্রাস্ট্রি প্রতিষ্ঠান। যেখানে দেশ-বিদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা লেখা-পড়ার সুযোগের পাশাপাশি প্রতিদিন হাজারো সব ধরনের রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে। এতে শিশু, প্রসূতি মা, ডেন্টাল রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা এবং ৫ শতাংশ বেডে সব দরিদ্র রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠানের এমন সেবা কার্যক্রম দেশ-বিদেশে প্রসংশিত। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারের কর্তা ব্যক্তি, বিদেশের রাষ্ট্রদূত এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তিরা এ সব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। মানবতার কল্যাণে নিবেদিত এই মহষী ব্যক্তি ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন। তবে মানবিক কল্যাণে নিবেদিত তার প্রতিষ্ঠিত স্থাপনাগুলোর জন্য তিনি বেঁচে থাকবেন চির অম্লান হয়ে বলে জানালেন সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের এমপি আলহাজ্ব আব্দুল মজিদ মন্ডল, বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সাধারন সম্পাদক এফ.আর সরকার, সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির উপদেষ্টা সাইদুল ইসলাম, একুশে ফোরামের সিরাজগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আকতারুজ্জামান তারুকদার। তারা জানান, তিনি অজো পাড়াগায়ে বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান করে আমাদের এলাকাকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়েছেন। রাখছেন আধুনিক শিক্ষা, চিকিৎসা সেবায় ভুমিকা। আমরা মানবতার এই বীরকে চিরদিন স্মরণ রাখবো।
এ দিকে খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসার ডা. হোসেন রেজা জানান, ডা. আমজাদ হোসেন সমারোহ, বিলাস-বাসনাকে পছন্দ করতেন না। তিনি মানবতা আর মানুষকে নিয়ে ভাবতেন। এত বিত্ত-বৈভরের মালিক হয়েও তিনি খুবই সাদা-সিদে দিন যাবন করতেন।
খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের ৬ সদস্য বিশিষ্ট পরিচালনা বোর্ড রয়েছে। এর মধ্যে প্রয়াত চেয়ারম্যান ডা. এম এম আমজাদ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ রয়েছেন পরিচালকের দায়িত্বে। আর পরিবারের অন্যান্য ৫ সদস্য রয়েছেন বোর্ডের সদস্য হিসেবে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, খাজা বাবা ইউনুছ আলী (রঃ) দিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রকৃত পক্ষে দেশের মানুষকে চিকিৎসা সেবা ও আধুনিক শিক্ষায় জাতিকে শিক্ষিত করতে আমার বাবা আমজাদ হোসেন অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন করেছেন। এটা আমাদের একার নয়, দেশের প্রতিটি মানুষের সম্পদ। তাই এ সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব সরকার সহ সকলের। তিনি জানান, আমার বাবা মানুষের কল্যাণের ব্রত নিয়ে যে নির্দেশনা দিয়ে গেছেন, আমরা তা বাস্তবায়নে স্বচেষ্ট থাকবো।
আজ রোববার সকালে ডাঃ মীর আমজাদ হোসেনের ৬ষ্ঠ মৃত্যু বার্ষিকীতে রুহের মাগফিরাত কামনা করে এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফ, খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজে ও হাসপাতালে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
একে//