পর্ব-১
কলড্রপ ও ডাটা ব্যবহারে অসন্তোষ বাড়ছে গ্রাহকদের
শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত : ০৭:১১ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৭:০৮ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার
মোবাইল ফোনের কলড্রপ ও ইন্টারনেট ডাটা ব্যবহারে গ্রাহকদের মাঝে দিন দিন বাড়ছে অসন্তোষ। থ্রি-জি থেকে ফোর-জি নেটওয়ার্ক চালু হলেও কলড্রপ হচ্ছে হরহামেশা।
এছাড়া ইন্টারনেট ডাটা প্যাকেজ ও তার মেয়াদ নিয়ে গ্রাহকের আছে নানা প্রশ্নও। ক্রয় করা ডাটার ঠিক কী পরিমাণ ব্যবহার করা হলো, তা যাচাই করার কোনো উপায় নেই গ্রাহকদের কাছে।
বিভিন্ন অপারেটর ও সংস্থা নিজেদের মতো সাফাই গাইলেও এসব কারণে নিজেদেরকে এক প্রকার জিম্মি মনে করছেন মুঠোফোন গ্রাহকেরা। মোবাইল ফোন গ্রাহকদেরর অসন্তুষ্টি এবং অভিযোগের বিভিন্ন দিক থাকছে দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে।
বিড়ম্বনার নাম কলড্রপ
একটি মুঠোফোন থেকে আরেকটি মুঠোফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ করেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানে কলড্রপ। মুঠোফোন গ্রাহকদের মধ্যে অনেকদিন থেকেই কলড্রপ ইস্যুতে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে, দেশের চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোর-জি চালু হওয়ার পর থেকে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু থ্রি-জি এবং ফোর-জি উভয় ধরণের সংযোগেই এখনও রয়ে গেছে এই সমস্যা।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান লিংক থ্রির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা ফরিদ মোহাম্মদ রাশেদ আমিন এ বিষয়ে বলেন, নেটওয়ার্ক কাভারেজের অঞ্চলের মাঝে এক ধরণের শূণ্যস্থান বা ব্ল্যাক হোল থাকে। বিটিএস টাওয়ারগুলোর নেটওয়ার্ক সেই জায়গাগুলোতে পৌছায় না। তখন সেখানে নেটওয়ার্ক তরঙ্গ পৌছানোর জন্য ওভারল্যাপিং করানো হয়। নেটওয়ার্ক না থাকা এবং ওভারল্যাপিং এই দুই কারণেই কলড্রপ হয়ে থাকে। আমাদের দেশের ভবনগুলোর অবস্থান এবং বিটিএস টাওয়ারের কারগরি জটিলতাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে জানান এই কর্মকর্তা।
কলড্রপের সমস্যায় বিড়ম্বনার সম্মুখীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নুরে আলম তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, মাঝে মাঝেই কথা বলার মাঝখানে হঠাৎ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
অনেক সময় আবার সংযোগ থাকলেও অন্যপাশ থেকে কোন শব্দ পাই না। আমার কথাও অনেকে শুনতে পায় না। তখন বাধ্য হয়ে আমাকেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হয়। এতে অল্প সময়ের কথা অনেক সময় নিয়ে বলতে হয়। আমার মোবাইলের বিল বাড়ে।
অনেকবার গ্রাহক সেবা কেন্দ্রে যোগাযোগ করেছি। তারা শুধু ‘দুঃখিত’ আর ‘দেখছি’ বলে জবাব দেন। তবে আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিকার পেলাম না। থ্রি-জি থেকে এখন আমরা ফোর-জি’তে আছি। তাও এমন নেটওয়ার্ক সত্যিই মেনে নেওয়া যায় না।
ইন্টারনেট ডাটা খরচের পরিমাণ যাচাইয়ের সুযোগ নেই
রাজধানীর একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরিজুল ইসলাম সম্রাট। মোবাইল ইন্টারনেটের মাধ্যমে পড়াশুনার অনেকখানি কাজ করে থাকেন তিনি। তাই বিভিন্ন মেয়াদ ও পরিমাণের ডাটা প্যাকেজ কেনেন তিনি। কিন্তু প্রায়ই ক্রয়কৃত ডাটার হিসেব নিকেষ মেলাতে পারেন না এই শিক্ষার্থী।
একুশে টিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, একদিন ১ গিগাবাইট (জিবি) ইন্টারনেট কিনলাম। কিছু সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করলাম। এরপর অপারেটর থেকে এসএমএস আসলো যে আমার আর ৪০০ মেগাবাইট (এমবি) বাকি আছে। এর মানে হচ্ছে আমি প্রায় ৬০০ এমবি খরচ করে ফেলেছি। কিন্তু আমি যেসব কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছি তাতে এর পরিমাণ এতো বেশি হওয়ার কথা না। এখন আমি বুঝতে পারছি না যে, আমি কোথায় আর কীভাবে এতো ইন্টারনেট ব্যবহার করলাম। আর আসলেই আমি ৬০০ এমবি ইন্টারনেট ব্যবহার করেছি কী না তা যাচাই করার কোন উপায়ও নেই আমার কাছে।
ইন্টারনেট ডাটার বিষয়ে গ্রাহকদের সবথেকে বড় অসন্তোষের বিষয় হলো ডাটার পরিমাণ যাচাই করার কোন সুযোগ না থাকা। গ্রাহক কী পরিমাণ ইণ্টারনেট ব্যবহার করলেন তার জন্য মুঠোফোন অপারেটরগুলোর কাছেই নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হয় তাদের।
সাধারণত মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করার পর মোবাইল অপারেটরের কাছ থেকে একটি ক্ষুদেবার্তা অথবা ইউএসএসআইডি বার্তায় ব্যবহৃত ডাটার পরিমাণ এবং অবশিষ্ট ডাটার পরিমাণ গ্রাহককে জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে তা নিয়ে কোন দ্বিধা বা দ্বিমত থাকলে ব্যবহৃত ডাটার পরিমাণ যাচাই করার কার্যত কোন পদ্ধতি নেই গ্রাহকের কাছে। তৃতীয় পক্ষের কিছু অ্যাপস থেকে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের পরিমাণ যাচাই করেন অনেক গ্রাহকই। তবে সেগুলোর দেওয়া তথ্য আমলে নেয় না মোবাইল অপারেটরগুলো।
অভিযোগ রয়েছে ইন্টারনেটের মেয়াদ নিয়েও। সাধারণ অর্থে ‘দিন’ শব্দটির অর্থ মোবাইল অপারেটরগুলোর কাছে যেন একেবারেই ভিন্ন। এমনই এক অভিযোগের সূত্র ধরে ব্যবহারিকভাবে বিশ্লেষণ করা হয় একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের ইন্টারনেট অফার। দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় মোবাইল অপারেটরে ৩১ টাকায় ২৫০ এমবি ইন্টারনেট কেনা যায়। এই ইন্টারনেটের মেয়াদ হিসেবে তিন দিন সময়ের কথা উল্লেখ থাকে বিজ্ঞাপনে। এই অফারটি মুঠোফোনে ক্রয় করে দেখা যায় পুরো তিন দিন সময়ের মেয়াদ দেয় না অপারেটরটি।
বিগত ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৫১মিনিটে এই অফারের ইন্টারনেট কেনা হয়। তিন দিন অনুযায়ী, এই অফারে ইন্টারনেটের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৫০ মিনিটে। কিন্তু ১০ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা পর্যন্তই ওই ইন্টারনেটের মেয়াদ দেওয়া হয় অপারেটরটির তরফ থেকে।
এছাড়া অভিযোগ আছে গ্রাহকদের নম্বরে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চালু হয়ে যায় বিভিন্ন ধরণের ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস বা ভ্যাস। আর এরজন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই গ্রাহকদের মোবাইল থেকে কাটা হয় বিভিন্ন অংকের টাকা।
এসব বিষয়ে টেলিকম প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং পোলারিস ফরেনসিক লিটিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা বলেন, অতীতে এ ধরণের অভিযোগ অনেক বেশি থাকলেও বর্তমান সময়ে বিষয়গুলো অনেকখানি কমে গেছে। এরপরেও যদি বিনাকারণে কোন অপারেটর কোন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কাটে অথবা পর্যাপ্ত ইন্টারনেট না দেয় এমনকি যদি কলড্রপ হয় তার একটি অডিট ব্যবস্থা বিটিআরসি’র কাছে থাকা উচিত। বিটিআরসি’র বিলিং সার্ভারে এর অডিট করার ক্ষমতা সংস্থাটির আছে। তবে নিয়ম করে সেই সার্ভার অডিট করা হয় কি-না সেটিই হচ্ছে দেখার বিষয়। কারণ কেউ যদি কোন ধরণের এদিক-ওদিক করেও লগ সার্ভার থেকে লগ মুছে ফেলা যায় না।
মোবাইল অপারেটরদের সেবায় গ্রাহক অসন্তুষ্টির অন্যান্য দিকের সঙ্গে অপারেটর প্রতিষ্ঠান এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসি’র বক্তব্য তুলে ধরা হবে দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে।
/ এআর /