ভূমিকম্প সহনীয় বিল্ডিং তৈরী করবেন কিভাবে
প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা
প্রকাশিত : ০৬:১২ পিএম, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার
সাম্প্রতিক সময়ে নেপালে ভূমিকম্পের পর আমাদের দেশের অনেকেই এখন বেশ নড়েচড়ে বসেছেন। যদিও এটা আরও আগেই ভাবা উচিত ছিল। কারণ ভূমিকম্প তথা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখন হবে তা সঠিক করে বলা যায় না। আবার এটা আমরা বন্ধও করতে পারি না। কিন্তু দুর্যোগের ক্ষতির হাত থেকে রেহায় পেতে প্রস্তুতি তো নিতে পারি। সেই প্রস্তুতি এখনই নেওয়া উচিত। বিশেষ করে নেপালের ভূমিকম্পের ঘটনায় অসংখ্য প্রানহানি আর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন উঠেছে ওই মাত্রা কিংবা তার চেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে আমাদের অবস্থা কী হবে?
একটা ভবন তৈরির সময় অনেক কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। এক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো ভাল ‘স্ট্রাকচারালার ডিজাইন’। ভূমিকম্পের বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে আমাদেরকে সেইদিকটাতেই অনেক বেশি নজর দিতে হবে। সঠিক নিয়ম মেনে ভবন তৈরি করা না হলে ভূমিকম্পের আঘাতে তা ভেঙ্গে পড়তে পারে কিংবা ভাল পাইলিংয়ের অভাবে ভীত মজবুত না হলে ভবন ধ্বসে পড়তে পারে। এজন্য ভীতটাকে মজবুত করতে হবে। এমনভাবে ভবন তৈরি করতে হবে যাতে এটি সহজে হেলে কিংবা ধ্বসে না পড়ে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিমাত্রার ভূমিকম্প হলে হেলে গেলেও ভবনের ছাদ কিংবা দেওয়াল যেন ধ্বসে না পড়ে। এই কাজটি নিশ্চিত করতে পারলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে অনেকাংশে রেহাই পাওয়া যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো এই কাজটি আমরা কিভাবে করব? আমাদের চারপাশে অনেকেই তো অনেক টাকা খরচ করে বড় বড় ভবন তৈরি করছেন। প্রকৌশলীদের দিয়ে নকশা তৈরির পরই তো এসব ভবন নির্মিত হচ্ছে। তবুও কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন হলো ভবনের নকশা কী অভিজ্ঞ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে? যদি এই প্রশ্নের উত্তর না হয় তাহলেই কিন্তু আশঙ্কা রয়ে যায়। দু:খজনক হলেও সত্যি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দেশে অনেক টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করা হলেও তা অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের দিয়ে নকশা তৈরি করা হয় না। ভবন তৈরিতে দামি দামি নির্মাণ সামগ্রী কিংবা সাজসজ্জার পেছনে অনেক টাকা ব্যয় করলেও ‘স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের ক্ষেত্রে আমরা খুবই কার্পন্য করি। একটা ভবন বাইরে থেকে যতই চাকচিক্যময় হোক না কেন তা যদি মজবুত না হয় তাহলে দেখা যাবে একসময় তা আমাদেরই মাথার উপর ভেঙ্গে পড়ছে। ইদানিং অনেকেই প্রকৌশলীদের বাদ দিয়ে আর্কিটেক্ট (স্থপতি) দিয়ে ডিজাইনের কাজ করান। এটা আরেকটা ভূল। ভবনের সৌন্দর্য্য বর্ধনে স্থপতিদের জুড়ি নেই। কিন্তু তাদের দিয়ে যদি স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের কাজ করানো হয় তাহলে সেটা কতটা টেকসই হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ তাদের মূল কাজ কিন্তু এটা না।
ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের আগে রাজউক থেকে নকশার অনুমোদন নেওয়ার বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়ম কানুন মেনে নকশা তৈরি করা হয় না। চোখ বুঝে এগুলোর অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। যারা এসব অনুমোদন দিচ্ছেন অনেকক্ষেত্রে তারাও অভিজ্ঞ নন। আরও আশ্চর্য বিষয় হলো ভবনের নকশা তদারকির যে টিম গঠন করা হয় সেখানেও অভিজ্ঞ স্টাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারদেরকে রাখা হয়না। অনেকসময় দেখা যায় কমিটির প্রধান একজন স্থপতি। ফলে ভবনের কোন ক্ষয়ক্ষতির পরই টনক নড়ে কর্তা ব্যক্তিদের। কিন্তু ততক্ষণে অনেক অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যায়। সাভারের রানা প্লাজা ধ্বসে বহু প্রানহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। যদিও এটি অনুমোদন নিয়েই করা হয়েছিল। প্রশ্ন হলো এই অনুমোদন কারা কিভাবে দিলো? এত টাকা খরচ করে যিনি ওই ভবন নির্মাণ করেছিলেন তিনি কেন সামান্য কিছু টাকা খরচ বাঁচাতে গিয়ে এতবড় সর্বনাশ কেন ডেকে আনলেন? ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হয়েছে। বিভিন্ন মহলে হৈ চৈ হয়েছে। আস্তে আস্তে তা থেমে গেছে, ভুলেও গেছেন অনেকে। আবারও সেই একই কায়দায় ভবন নির্মাণ হচ্ছে। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না।
বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি যিনি নকশা তৈরি করছেন বা অনুমোদন দিচ্ছেন প্রকৌশল বিদ্যা সম্পর্কে তার কোন জ্ঞানই নেই। ফলে তিনি আন্দাজে নকশা তৈরি করেন। এতে করে অনেক ক্ষেত্রে নির্মাণ ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। আবার কখনও ভবন হয় নড়বড়ে। এই ধরনের ভবন নির্মাণ করা হলে ভূমিকম্পের সময় একটা ভবন যত প্রকার উপায়ে নড়াচড়া করা উচিত তার চেয়ে কম বা বেশি করবে। ঝুঁকিটা এখানেই। অনেকটা হাতুড়ে কিংবা অনভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতো। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগির প্রকৃত অসুখ জেনেই ওষুধ দেন। এতে রোগি যেমন সুস্থ হন আবার তার খরচও তুলনামূলক কম হয়। কিন্তু যিনি অভিজ্ঞ না তিনি রোগের ধরন না বুঝে আন্দাজে একগাঁদা ওষুধ দিয়ে দেন। যেটা লেগে যায়। ফলে রোগ ভাল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার কখনও কখনও ভাল হলেও বাড়তি ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বেশি ওষুধের কারণে রোগির খরচও বেড়ে যায় অনেক। ভুল চিকিৎসার কারণে একজন মানুষের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু অনভিজ্ঞদের দিয়ে যদি ভবনের নকশা তৈরি করা হয় তাহলে অসংখ্যা মানুষের প্রানহানিসহ বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।
অন্যান্য দেশে ভবন নির্মাণের আগে স্ট্রাকচারাল ডিজাইনের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী নকশা তৈরির পর তা আবার অন্য আরেকজন অভিজ্ঞকে দেখানো হয়। তিনি তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি দেখেন কোন সমস্যা আছে তাহলে যিনি নকশা করেছেন তার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। প্রয়োজনে তারা দু’পক্ষ একসঙ্গে বসে সমাধান করেন। কারণ একজন মানুষ যতই অভিজ্ঞ হোন না কেন অনেক সময় তার অনিচ্ছাকৃত ভূলও হতে পারে। বিষয়টা অনেকটা চিকিৎসকদের বোর্ড বসানোর মতো। অভিজ্ঞ চিকিৎসক হওয়ার পরও জটিল অস্ত্রপচারের আগে আরও কয়েকজন চিকিৎসক একসঙ্গে বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে উপনিত হন। অস্ত্রপচার কিন্তু একজনই করেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেন সবাই মিলে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার।
আমরা বলি ভূমিকম্পের সময় ঘর থেকে বের হওয়া বেশি বিপদজ্জনক। কথা সত্যি। ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পিলার কিংবা বিমের নিচে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে করে ছাঁদ বা দেওয়াল ভেঙ্গে গায়ে আঘাত না লাগে। কিন্তু পিলার কিংবা বিম যদি মজবুতই না হয় তাহলে তো সেটিই আগে মাথার উপর ভেঙ্গে পড়বে। তো ঘর থেকে বের হওয়া আর না হওয়া তো সমান কথা হলো।
আধুনিক বিশ্বে ইটের বদলে কংক্রিট দিয়ে ভবন নির্মিত হচ্ছে। কারণ এটি মজবুত বেশি। খরচ বড়জোর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেশি হয়। আমরা অনেকেই এই সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে সারাজীবন ঝুঁকির মধ্যে বসত করি।
ভবনের নকশা তৈরির ক্ষেত্রে বেশ কিছু গাণিতিক বিষয় জড়িত। আমেরিকাসহ অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে আমাদের দেশের ছেলেরা গণিতে বেশ এগিয়ে। অথচ ভাল স্ট্রাকচারাল ডিজাইনে আমরা বেশ পিছিয়ে। এখনও বড় কোন ব্রিজ কিংবা স্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদেরকে বাইরের থেকে ভাড়া করা প্রকৌশলী নিয়ে আসতে হয় (যদিও আমাদের দেশে কিছু অভিজ্ঞ স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার তৈরি হয়েছেন) এটা খুবই দু:খজনক। অথচ আমরা চাইলেই এক্ষেত্রে অনেক ভাল করতে পারি। সমস্যা হলো আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশই প্রকৌশল ডিগ্রী নেওয়ার পর আর পড়ালেখা করতে চায় না। অথচ ভাল প্রকৌশলী হতে কর্মজীবনে বেশি বেশি চর্চা ও পড়ালেখার কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা প্রতিষ্টানে অনেক কিছুই হাতে কলমে শেখার কিংবা শেখানোর সুযোগ নেই। এখনকার সময় আরও কঠিন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই তাদের শিক্ষকতা পেশাকে খণ্ডকালীন চাকরি হিসেবে নিয়ে বাইরের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকেন। ক্যাম্পাসে বসেই তারা নিজেদের কাজে সময় দেন বেশি। অন্তত ৯০ শতাংশ সময়ই অনেকে বাইরের প্রতিষ্ঠানে কনসাল্টেন্সী কিংবা ব্যক্তি কাজে ব্যয় করেন। বাকি ১০ ভাগ সময় দিলে শিক্ষার্থীরা আর কতটুকুই বা শিখবে? আমরা যখন শিক্ষকতা করেছি তখন এই রেওয়াজ এত বেশি ছিল না।
ইদানিং অনেকেই পুরনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা যাচাইয়ে জন্যই কম্পন পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারণ করে দেখেন আসলেই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা। এগুলোর একেবারেই ভিত্তিহীন। একটা ভবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা নির্ণয়ের জন্য ভবন তৈরির সময়ের নকশা না থাকলে তা বলা মুশকিল। নকশা দেখেই ভবনটি সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে। আবার কিছু কোম্পানী বিজ্ঞাপন দিচ্ছে- তাদের রড নাকি ভূমিকম্প সহনশীল। কথা হলো- ভূমিকম্পে তো রডের ক্ষতি হয়না। এগুলো তো এমনিতেই ভূমিকম্প সহনশীল। দেখতে হবে এই রড যেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা আসলে সঠিক প্রক্রিয়ায় করা হচ্ছে কি না। এভাবে মানুষকে বোকা বানানো মোটেও ঠিক না।
আসলে আমরা যে যেখানেই কাজ করি না কেন কাজের প্রতি আন্তরিক হতে হবে। সততা, দায়বদ্ধতার সঙ্গে সবাই যদি নিজের পেশায় কাজ করেন তাইলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। সামান্য খরচ বাঁচাতে গিয়ে যেন নিজেদের ক্ষতি ডেকে না আনি। প্রকৌশলীদেরকে নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে চিন্তা করতে হবে। একটা বিষয়কে কিভাবে আরও উন্নত করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমাদের দেশে বেশি বেশি গবেষণা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এজন্য সময় দিতে হবে। যারা এসব ব্যাপারে আগ্রহী তাদেরকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সঠিক প্রক্রিয়ায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রাজউক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এ ব্যাপারে আরও আন্তরিক হওয়া দরকার। তবেই তো না একটা ভাল কিছু করা সম্ভব।