টেস্টিং-সল্ট সুস্বাদুর নামে ‘স্নায়ু বিষ’
প্রকাশিত : ০৮:৪৮ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট, সংক্ষেপে এমএসজি। ‘টেস্টিং-সল্ট’ নামেই এটি আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। এটি খাদ্যকে সুস্বাদু করে। তাই অনেকেই এটি খেয়ে থাকেন। কিন্তু এর ক্ষতিকর দিকগেুলো জানলে এ ধরনের খাদ্য এড়িয়ে যাবেন অনেকেই। বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাবার যেমন নুডলস চিপ্স ফাস্টফুড এবং প্রধানত চাইনিজ খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে এটি। যুক্তি একটাই-এতে খাবারটা হবে আরও মজাদার ও সুস্বাদু। কিন্তু কৃত্রিম স্বাদ বৃদ্ধিকারী টেস্টিং-সল্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী একাধিক গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ এক ভয়ানক নীরব ঘাতক। পাশ্চাত্যের একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেস্টিং-সল্টের আগ্রাসন বিশ্বজুড়ে এলকোহল ও নিকোটিনের চেয়েও বড় বিপদ ঘটাতে পারে। তাই এখনই সময় এ ধরনের খাবার পরিহার করার।
বিশ শতকের শুরুর দিকে ১৯০৮ সালে জাপানি রসায়নবিদ ও টোকিও ইমপেরিয়াল ইউনিভার্সিটির গবেষক কিকুনেই ইকেদা এটি উদ্ভাবন করেন। তখন এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খাবার-সুগন্ধকারী উপাদান হিসেবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে অনেকগুলো গবেষণায় ক্রমেই এর স্বাস্থ্যহানিকর দিকটি সচেতন বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন।
গবেষকদের মতে, টেস্টিং-সল্ট নানাভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতিসাধন করে। বিভিন্ন গবেষণা-প্রতিবেদনে তাই একে অভিহিত করা হয়েছে ‘স্নায়ু বিষ’ হিসেবে। শিশুদের জন্যে এটি আরও মারাত্মক। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, টেস্টিং-সল্টের প্রতিক্রিয়ায় তীব্র মাথাব্যথা, হজমযন্ত্রের গোলযোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, খিঁচুনিসহ বিভিন্ন রকম সমস্যা এমনকি দীর্ঘমেয়াদে মস্তিষ্কের ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
শিশুরাই আছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে-
ভোজন রসিকদের কাছে চাইনিজ, ইন্ডিয়ান ও থাই রেস্টুরেন্টগুলোর খাবার পছন্দের শীর্ষে। জানা গেছে, এসব রেস্টুরেন্টে পরিবেশিত স্যুপ, ফ্রাইড রাইস, ফ্রাইড চিকেনসহ প্রায় সব খাবারেই টেস্টিং-সল্ট ব্যবহার করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সে কারণেই চাইনিজ খাবার এতো সুস্বাদু। শুধু তাই নয়, ছোট বড় বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকানগুলোর খাবারেও এর ব্যবহার এখন রীতিমতো মাত্রাছাড়া। টেস্টিং-সল্টের আগ্রাসন থেকে বাদ যাচ্ছে না কাবাব এবং সাধারণ হোটেলের খাবারও।
পৃথিবীর অনেক দেশেই খাদ্যপণ্যে টেস্টিং-সল্টের ব্যবহার সরকারি আদেশে নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত। তাই কিছু বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে যারা সেসব দেশে তাদের পণ্যে টেস্টিং-সল্ট ব্যবহার করতে না পারলেও কেবল দুর্বল আইনের সুযোগ নিয়ে এদেশে অনায়াসেই টেস্টিং-সল্টযুক্ত খাবার বাজারজাত করছে। তেমনই একটি বহুজাতিক কোম্পানি আমাদের দেশে বাজারজাতকৃত তাদের ব্র্যান্ডেড স্যুপ ও নুডলসে টেস্টিং-সল্ট ব্যবহার করছে। কিন্তু পাশের দেশ ভারতে তারা তা পারছে না বরং ওখানে তাদের পণ্যের মোড়কে উল্লেখ থাকে-‘নো এডেড এমএসজি’ অর্থাৎ এটি টেস্টিং-সল্টমুক্ত।
শিশুদের পছন্দের খাবার চিপ্স। এতে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত টেস্টিং-সল্ট। এ-ছাড়াও প্যাকেটজাত স্যুপ, নুডলস, সসেজ, বোতলজাত মাংস ও সব্জি, এমনকি চানাচুর, ডাল ভাজা এবং কোনো কোনো কোম্পানির বিস্কুটের মতো অনেক শুকনো খাবারে পর্যন্ত এটি হরদম মেশানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একজন পরিণত মানুষের চেয়ে শিশুর মস্তিষ্কের কোষকে টেস্টিং-সল্ট দ্রুত নিষ্ক্রিয় ও অবসন্ন করে দিতে পারে। তাই অভিভাবকরা নানা ব্র্যান্ডের চিপ্সের নামে সন্তানদের জন্যে মূলত বিষ কিনে দিচ্ছেন।
টেস্টিং-সল্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী যত গবেষণা হয়েছে তার সবগুলোতেই প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর। আর ক্ষতির পরিমাণ প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে চারগুণ বেশি। এ কারণে ১৯৬৯ সালে শিশুদের খাবারে টেস্টিং-সল্টের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
পুষ্টিবিজ্ঞানী জুডিথ রিচার্ড বলেন, চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পর যদি কারো তীব্র মাথাব্যথা, বমি ভাব, খিঁচুনি, চামড়ায় ফুসকুড়ি, হাত-পায়ে দুর্বলতা ও কাঁপুনি, বুকে চাপ, অবসাদ, ঝিমুনিভাব ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়, তবে বুঝতে হবে এটি টেস্টিং-সল্টের প্রতিক্রিয়ার ফল। এ সবগুলো লক্ষণকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নামকরণ করেছে ‘চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সিনড্রোম’। আর এর প্রধানতম কারণ টেস্টিং-সল্ট।
এ-ছাড়াও টেস্টিং-সল্টযুক্ত খাবার গভীর মনোযোগে কাজ করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে, মেজাজ হয়ে উঠতে পারে তিরিক্ষি। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো, টেস্টিং-সল্ট পুরোপুরি বর্জন করুন এবং যতটা সম্ভব এসব রেস্টুরেন্ট এড়িয়ে চলুন।
আর, কোনো খাবারে টেস্টিং-সল্ট আছে কি না, সেটি একটু খেয়াল করলেই বোঝা সম্ভব। এসব খাবার মুখে দিলেই একটা ঝাঁঝালো নোনা স্বাদ পাওয়া যায়। ওটা টেস্টিং-সল্টেরই ‘কৃতিত্ব’। এটি ছেলে-বুড়ো সবার কাছেই বেশ সুস্বাদু ঠেকে, তাই এসব খাবার খেতে মন চায় বার বার।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন থেকে সংগৃহীত।
এসএইচ/