ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

আমার মায়ের গল্প

ফরিদা ইয়াসমিন জেসি

প্রকাশিত : ০৯:৩৬ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ০২:২৪ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার

লেখকের মায়ের সেই শাড়ি

লেখকের মায়ের সেই শাড়ি

আমার মায়ের গল্প-

আমি দেশের সর্বোচ্চ স্কুল ভারতেশ্বরী হোমসে পড়েছি একথা সবাই জানো, বাবার আয় কম হলেও কপাল খুলেছিলো বড় চাচার সহায়তায়। মা ছিলো আমার আনাড়ি, পল্লী গায়ের ঘরোণী। মা ছিলো আমার শ্যামল অঞ্চলের স্নিগ্ধ ছায়ার মত সরলা। বিশাল অট্টালিকার স্কুল কপাটের সামনে দাঁড়াতো মা জড়োসড়ো হয়ে, এরকম দালান গেটে আসেনি যে কখনো আগে। পড়নে থাকতো মায়ের সবুজ জমিনে লাল পেড়ে একটি আটপৌরে শাড়ি। গর্বিত হতো মা, মেয়েটি তার এই স্কুলে পড়ে অন্যকোনো ধনীর দুলালিদের সঙ্গে।
মেয়ে অট্টালিকায় হলেও মায়ের স্থানতো ছিলো পাড়াগায়েই। আটপৌরে জীবনে। প্রীতি আর ভালোবাসায়,পৃথিবীর বিলাস দেখিনি কখোনো, জানেনিও কি হয় তাদের সাজ।


একই শাড়িতে মা আসতো মাসের পর মাস, আমার অভিবাবক দিবসে আমাকে দেখতে। হাতে থাকতো একই ভেনেটি ব্যাগ, পায়ে থাকতো একই জুতো।
আমার বান্ধবী নিলা, তার মায়ের জরুয়া শাড়ি আর হাতে মুক্তখচিত ভ্যানিটি ব্যাগ দেখে আমার মনের কোনটা চিনচিন করতো, মনের ভাষায় বলতাম"মা একই শাড়ি কেনো পড়ে আসো বার বার?

মায়া ভরা মায়ের অন্তর চোখ বুঝে নিতো আমার মনের স্বচ্ছ অনুবাদ। স্মিত হেসে বলতো- ক্ষেতে এবার এসেছে সোনালী পাকা ধান, ধান বেচে কিনবো এবার জোতস্না রঙ এর নতুন শাড়ি। এরপর আমার চিন্তিত কপালে দিতো রাশি রাশি ভালোবাসার সোহাগ।
"তুমি জানো ও মা আমাকে ভুলানোর শুদ্ধ শিল্পকলা।" আমি জানি,

বাবার আয়ের সবটাই যাবে আমাদের খরচে তোমার শাড়ি কেনার কথা নির্ঘাৎ ভুলে থাকবে তুমি আরো কয়েক বছর। বন্ধু মিতার চাকরিজীবী মা আসতো আটশাট পোশাকে, লজ্জিত হয়ে মা চোখ সরিয়ে নিতো আমার চোখ থেকে। কথা রাখতে পারেনি বলে। একই শাড়িতে এসেছে মা আমাকে দেখতে, কড়কড়ে মাড়ের আইরন করেছে শুধু শাড়ীতে এটুকুই ব্যবধান।

মা কে নিয়ে স্বপ্নে ডুবে যাই নিমিষেই, চাকরিতে যদি মায়ের যাওয়া হতো, মায়ের হাতে টাকা যদি হতো। শেফালিফুলের মত মুখটা মায়ের আজ কালোবরণ মেঘ ঢেকে দিতোনা সংকুচে।

সেইবার প্রাথমিক বিত্তি পেলাম। হাতে পেলাম বিত্তির চারশো টাকা, বিত্তি প্রাপ্তীর সঙ্গে বন্ধুরা কিনলো তাদের শখের ড্রেস, আমি কিনলাম কলাপাতা রঙ এর শাড়ির কাপড় আর খয়েরি রঙ এর ঝিলমিলে সুতা। বন্ধুদের নিয়ে শুই সুতাই করলাম কাজ শাড়িতে। মাকে সাজাবো বলে। ছুটিতে গিয়ে মায়ের হাতে দিলাম তুলে।

হেসে বললো মা, " পাগলি মেয়ে। একি তোর পাগলামি, আমাকে কেনো? তোর আব্বার তো এক্টাই শার্ট।"
"আছে মা আব্বার জন্যও আছে কাল দোকানে নিয়ে যাবো আব্বাকে কিনে দিবো পছন্দ মত শার্ট।"
চারশো টাকার বিত্তির আয়ে আমি ভবিষ্যত এর জীবনযাপনের মানচিত্র দেখতে পাই। আব্বার একটা শার্ট এর জন্য বিষাদ আর কষ্টে মায়ের দগ্ধ হওয়ার সমাধি দেখতে পাই।

নিজের আয়ের টাকা মায়ের যদি হতো? কিনে দিতো মা এক রাজ্যের মূল্যবান পোশাক আব্বাকে, মেয়ের লজ্জা ঘুচাতে নিজে কিনতেন রানীর বেশি সাজ।
মায়ের আয়ের টাকা যদি হতো! স্নেহ ভরা মায়ের হাত প্রসারিত হতো অনেকদূর
- আমার বুক কিপিং বই কেনা হতো, বাল্যবন্ধু রা তিরস্কার করতো ক্লাসের প্রথম ছাত্রী হয়েও বই কেনো চেয়ে বেড়াও। ব্যাটমিন্টন কেনা হতো যখন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম বন্ধুদের সিলবার রঙের ব্যাট মিন্টন দেখে। খেলতে চাইলে শুনতাম কিনে কেনো নাওনা ক্লাসের প্রথম যদি হয়েছো।
অমলাদিদির কাছ থেকে বিকেল বেলা বাটারবান আর ক্রিম রোল কিনে খাওয়া হতো। বন্ধুরা খেতো চেয়ে চেয়ে থাকতাম শুধু। খাইনি কখোনো স্বাদ মিটিয়ে।
মাকে বলেছি এই সব কথা কতবার। নিশেষ করেছেন আব্বাকে জেনো না বলি কষ্ট পাবেন দিন রাত খাটুনির পর। অপরাগতার কষ্ট।


মা ও ভাবতেন দুটাকা আয়ের পথ যদি হতো গড়তাম সুসজ্জিত স্নিগ্ধ জীবন, সহায়তা দিতো আব্বাকে যে কিনা গোপন রুমালে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে অশ্রু জল।


আব্বাকে সহায়তা দিতে পারেনি মা তাই বেদনাও দিতে চাইনি৷ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলো মা। আমি জানলাম। আব্বাকে জানালো হলো না। ভেংগে যাবে তার মন। আব্বার আয়ের টাকার আমাদের প্রয়োজন লেখা পড়া চালাবার জন্যে। একাকি অন্ধকারে নিমজ্জিত জীবনের পরেও ভোরের আলোর মত উদ্ভাসিত মন আমি দেখিনি কখনো মা কে দেখা ছাড়া।


অসুস্থতা বেশি হলে একদিন আব্বার প্রশ্নে মা জবাব দেন, তুমিতো জানোনা আমার ক্যান্সার হয়েছে, দিন গত হয়েছে অনেক। আর কেউ নয় মেয়ে আর আমি জানি।
জমিন ফেটে যায় আব্বার যখন জানতে পারে কয়েক যুগ আর শতাব্দী নয় সল্প আয়ুর দিন শেষে আকাশের উপরে হবে আমার মায়ের ঠিকানা।


কয়েকদিন করালেন হোমোউপথিক দাওয়ায় সাধ্যমত আব্বার। তারপর রোগ বাড়তেই থাকলো বাড়তেই থাকলো। আমরা রইলাম ইউনিভার্সিটিতে ভাই বোনেরা, মা একা বাড়ি। ক্ষণস্থায়ী জীবনের ডাক এসে গেছে জেনেও বার্তা পাঠাইনি পড়ার ক্ষতি হবে সন্তানদের। একা হাস্পাতালে ৪ সন্তানের জননী, আমার সেই মহিয়সী মা জোতস্নাপ্লাবিত এক রাতে চলে গেছেন এক কুটি বছরের স্বপ্ন নিয়ে। বলেছিলো নাকি পরশিদের ডেকে, ডেকোনা ওদের, ওদের পরিক্ষা চলতেছে, আমিতো চলেই যাচ্ছি, কেনো পড়ার ক্ষতি করবে। ওরা বড় হবে, আয় করবে জীবন চালাবে নিজের স্বপ্নমত।

আমি আজো দেখি আমার মায়ের মুখ অসংখ্য মায়ের মুখে, আজো দেখি পতাকার মত আমার মায়ের সবুজ জমিনে লাল পাড়ের শাড়িটি অসংখ্য মায়েদের পড়নে। যাদের সন্তানেরা সরমে নত থাকে বন্ধুদের কাছে একি শাড়ি মা কেনো পরো বারে বারে। মায়ের মুখটিও থাকে বিষন্নতাতে।
আমি তাই গড়েছি আর্ন এন্ড লিভ, প্রতিবন্ধী শিশুদের মায়েদের জন্য, প্রতিবন্ধী বোনদের জন্য, অসহায় মায়েদের জন্যে।
মা তুমি অনন্ত জীবনের উপারে বসে দেখছো কি তোমার সেই পাগলি মেয়েটি মায়েদের জন্য করেছে একটি প্লাটফর্ম, ওদের আয়ে তাদের সন্তানেরা থাকবে দুধে ভাতে আর সংসার হবে দুজনের আয়ের টাকায় একে অপরের সহায়ক। মায়েরা ধরবে হাল বাবার সঙ্গে, সন্তান এর চাওয়া করবে পুরন সহাস্যে।

বি.দ্র. আমার মায়ের চারটি সন্তান আজ চারটি দেশে থাকে - বাংলাদেশ, লন্ডন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া। আমরা একে অন্যের সন্তানকে মা বলে ডাকি। মধুমাখা এই ডাক। জুড়িয়ে দেয় অন্তর।

এসএইচ/