বাসি মধুচিন্দ্রমায় কলকতা…
সৈয়দ নুরুল ইসলাম
প্রকাশিত : ০৮:২৭ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ রবিবার
২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সাল নতুন বউকে ঘরে ঢুকিয়ে আনুষ্ঠানিক সেরে ছুটে গেলাম সস্মেলনস্থল এ এল খান হাই স্কুল প্রাঙ্গণ। মোহরা ওয়ার্ড যুবলীগের সম্মেলন। ওয়ার্ড ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়েই নিয়েছিলাম যুবলীগের দায়িত্ব। বিয়ের দিন যুবলীগের দায়িত্ব ছেড়ে পূর্ণ মনোযোগ জীবনে এবং জীবিকার দিকে। রাজনীতি কারো পেশা হতে পারে কখনও ভাবিনি এবং ভাবিনি ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। সঙ্গে রেখেছি রাজনীতি।
বিয়ের পর মুধুচিন্দ্রমা বলে একটা বিষয় আছে শুনছি, কিন্তু জীবনের টানে ছুটতে গিয়ে তার মর্মার্থ বুঝিনি। বছরখানেক পর ভাবলাম কলকাতায় জন্ম নেওয়া যে মেয়েকে বউ করেছি। তাকে নিয়ে তার জন্ম শহরটায় একবার ঘুরে আসি না কন? সাহস করে মাকে বলতেই অনুমতি মিলে গেলে। বড় ভাইও সম্মত। ভিসা হয়ে গেলো টিকিটও হলো, ঢাকা-কলকতা-ঢাকা। ঢাকাতে গিয়ে শ্বশুর বাবাকে জানালাম, কলকতা যাবো, সঙ্গে আপনার মেয়েও, কথা বলতেই শ্বশুর বাবা খুশিতে দুহাত তুলে দোয়া করলেন। পাশে দাড়িয়ে পারিবারিক ঐতিহ্যের গল্প শোনালেন। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট হয়ে পার্ক সার্কাসে উনাদের বাড়ি দেখে আসতে হবে।
কলকাতা জাদুঘরে সময় নিতে দেখতে হবে। ভিটটোরিয়া মেমোরিয়াল হলে গিয়ে দেখে আসতে হবে। অবিভক্ত বাংলার ঐতিহ্যবাহি পারিবারের তালিকা। যেখানে উনাদের পরিবারের নাম ৪ নম্বরে। আরও কত কথা কত উপদেশ।
সব মনোযোগ দিয়ে শুনে মনে হলো ওনার মন প্রাণে আছে আজও কোলকতায়। অবশেষে বহু কাঙ্ক্ষিত কলকাতা যাত্রা। এয়ারপোর্ট নেমেই অ্যাস্বাসেডর ট্যাস্কিক্যাব চেপে সুদ্দর স্ট্রিট পূর্বনির্ধারিত হোটেল শিল্টন। রুমে টুকেই দেখি বউয়ের মনটা যেন কেমন মলিন।
কিছু না বলেই চলে গেলেন পাশের নিউমার্কেট। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসলো হাতে বেড শিট, পিলেকাভাল লাক্স সাবান, টাওয়াল হারপিক, এসব নিয়ে। কিছু জিগ্যেস না কলেই বুঝে নিলাম পশ্চিমবঙ্গে বনেদি পরিবারেরর মেয়ের ১০০ রুপির হোটেল রুম পছন্দ হয়নি। মনটা অনেক ছোট হয়ে গেল। আজমির হয়ে দিল্লি ঘুরবো। তাই পকেটে যে পরিমাণ টাকা আছে তা দিয়ে এর চেয়ে ভালো হোটেল ওঠার সাহস হলো না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম ভবিয্যতে ভালো হোটেলে ওঠার সার্মথ্য না হওয়ার অব্দি আর বিদেশ যাবো না। আল্লাহ তা কবুল করছেন। এরপর থেকে পৃথিবীর যে প্রান্তেই গেছি ৩ তারকা মানের নিচে কোন হোটেলে থাকতে হয়নি।
কলকাতা জাদুঘর পার্ক স্ট্রিক পার্ক সার্কাস ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল হল। ডালহৌসি রাইটার্স বিল্ডি, হাওড়া ব্রিজ ঘুরে-ঘুরে দেখা কলে স্ট্রিটে গিয়ে শরৎ রচনাবলী গীতাঞ্জলিসহ হরেক পদের বই কেনা মিউমার্কেট দাড়িয়ে সন্ধ্যায় ফুচকা খাওয়া, এভাবে দেখতে-দেখতে পাঁচ দিন শেষ হয়ে গেল।
রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে দীর্ঘ যাত্রা- দিল্লি, দিল্লি থেকে পিস্ক সিটি ট্রেন ধরে জয়পুর, এরপর বাস চেপে আজমির। বাস থেকে নামতেই বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। মাথায় টুপি, পরনে শেরওয়ানি, ২০-২২ বছরের একদল তরুণ আমাদের নিয়ে রীতিমত টানাটানি ফেলে দিল। বউ তো ভয়ে কাঁপছে। সাহস করে একটা রিকশা ডেকে উঠেই ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে বললাম, মুয়াল্লেম সায়েদ রহিমের বাড়ি যাবো। রিকশাওয়ালা যখন সায়েদ রহিমের বাড়ি যাবো। রিকশাওয়ালা যখন সায়েদ সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন তখন রাত ১০টা। পরে জানলাম বাসস্ট্যান্ডের ও যুবকগুলো বিভিন্ন মুয়াল্লেমের এজেন্ট!।
সায়েদ সাহেবের বাড়িতে আতিথেয়তার অভাব অনুভব করিনি। তারপরও সকাল হতেই বিদায় নিয়ে পাশের একটি হোটেলে চলে এলাম। মনে হচ্ছিল যেন বেঁচে গেলাম। দুপুরের মধ্যে খাঁজা বাবার জিয়ারত করে বিকেলের ট্রেনে ফিরে এলাম পিক্স সিটিখ্যাত জয়পুর। স্টেশনে নামামাত্র সেই একই অভিজ্ঞতা। জনদশেক যুবক ঘিড়ে দাঁড়ালো। একজন বলে তো ইধার আও আরেকজন বলে ওধার যাও। রীতিমত টানা-হেঁচড়ার মধ্যে পড়ে গেলাম। পাশে পুলিশের সাহায্য চাইতে গেলে পুলিশ বেটা বলে ঘাবড়াও মাত? কোনো রকমে প্রায় দৌড়ে ওঠে গেলাম আটোতে। হোটেল বলতেই নিয়ে গেল কাছকাছি। এক হোটেলে অটো ড্রাইভার লোকটা ভালোই। মনের মতো দামও কম। ট্রেনের ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা জানাতেই হোটেল ম্যানেজার যা বলব, তার অর্থ হচ্ছে ওই ছেলেগুলো হোটেলের দালাল।
আজমিরে ওরা মুয়াল্লেমের দালাল, জয়পুরে হোটেলের দালাল। আজমিরে ওরা মুয়াল্লেমের দালাল! দিল্লি গিয়ে কোন দালালের মখোমুখি হতে হয়, সেই চিন্তা করতে করতে পিস্ক সিটির পিস্ক রঙ আর মন দিয়ে দেখাই হল না ।
লেখক: চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী (ওয়েল গ্রুপ অব)।
এসএইচ/