মুহিত ভাই অন্তত ১০০ বছর বাঁচবেন: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
প্রকাশিত : ০২:২০ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০২:২৬ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। তিনি বঙ্কিম চন্দ্রের এক বইয়ের কমলাকান্ত চরিত্রের বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস কাহারো কাহারো কিছু কিছু আপত্তি থাকিলেও মুহিত ভাই (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত) অন্তত ১০০ বছর বাঁচবেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের ৮৫ তম জন্মদিন এবং সংকট ও সুযোগ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করেন তিনি। এ সময় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলামসহ বরেণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের দেওয়া বক্তব্য পাঠকের উদ্দেশ্যে হুবহু তলে ধরা হলো-
এটা খুবই আনন্দের কথা যে একজন মানুষ আমাদের দেশে ৮৫ বছরে পা দিচ্ছেন। এ জন্য তাকে অভিনন্দন জানানো উচিত। অর্থমন্ত্রী নিজেকে ৮৫ বছরের বলে গর্ব করতে পারেন। কারণ আমাদের দেশে এই সেদিনও কিন্তু ৬০ বছর ছিল বিরাট বয়স।
বঙ্কিমের কমলাকান্তের দপ্তর বইটা আছে। তার মধ্যে কমলাকান্ত নামে একজন লোক আছে। সেই লোকের বয়স মনে হয় ৫৫-৫৬ বছর। বঙ্কিম যখন লিখেছেন তখন তার বয়স ৩৭ বছর। কিন্তু এমনভাবেই তিনি কমলাকান্তের ছবি বইটাতে একেছেন, যে মনে হয় কমলাকান্ত অশিতিপরবৃত্ত।
আদালতে জর্জ জিজ্ঞেস করছেন যে কমলাকান্ত তুমি কি জীবিত আছো? কারণ ইতিমধ্যে রটে গিয়েছিল যে কমলাকান্ত আর বেঁচে নেই। ধর্মাবতর জিজ্ঞেস করলেন যে, কমলাকান্ত তুমি কি জীবিত আছো? তখন কমলাকান্ত উত্তর দিলো- ধর্মাবতর আমি এখনও জীবিত আছি এবং কাহারো কাহারো কিছু কিছু আপত্তি থাকলেও আরো কিছুদিন বেঁচে থাকিব। তো তখন যেটা ছিল ৫৬ বছর। আজ সেটা হয়েছে ৮৫ বছর।
সুতরাং আমার দৃঢ় বিশ্বাস কাহারো কাহারো কিছু কিছু আপত্তি থাকিলেও মুহিত ভাই (অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত) অন্তত ১০০ বছর বাঁচবেন।
উপেন্দ্র কেশর রায় চৌধুরী। সত্যজিত রায়ের বাবা সুকুমার রায়, তার বাবা। তার একটা বই আছে। বইটা সম্পর্কে আপনারা সবাই জানেন। সেটা হচ্ছে ‘ছেলেদের রামায়ণ’। তার প্রথম লাইন হচ্ছে অযোদ্ধার রাজা দশরাতের ৬০ বছর পূর্ণ হইয়াছে। কাজেই বুঝিতে পারিতেছ কি বুড়াটাই না তিনি হইয়াছে। যদিও মূল রামায়ণে আছে ৬০ হাজার বছর। আর মুহিত ভাই আজকে চিন্তা করেন। সেই বৃদ্ধ রাজা দশরাতের চেয়ে ২৫ বছর পর একদম তারুণ্যদীপ্ত চেহারা নিয়ে বসে আছেন মুহিত ভাই। এখনও তার স্মৃতির কোন গোলমাল নেই। উনার পাশে যে আনিস স্যার বসে আছেন এ দু’জনেরই স্মৃতি ঘটিত কোন সমস্যা নেই। এটা আমাদের জন্য খুবই বিপদজনক।
আমি চিন্তা করে দেখলাম আজ সকাল বেলা। ৮৫ বছর কত বয়স! আমি দেখলাম কনফুসিয়াসের চেয়ে ১২ বছর বেশি। চীন ২ হাজার বছর ধরে যাকে অনুস্মরণ করছে তার চেয়ে ১২ বছর বেশি। যদি শুধুমাত্র বয়স দিয়ে সিনিয়র-জুনিয়র মাপা হতো। তাহলে এসব বিরাট বিরাট লোকেরা মুহিত ভাইয়ের কাছে কি?
কনফুসিয়াস ছাড়া তিনি সক্রেটিসের চেয়ে ১২ বছরের বড়। উনি গৌতম বুদ্ধের চেয়ে ৪ বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ৫ বছরের বড়। গেটের চেয়ে ৩ বছরের বড়।
যাহোক আমার খুব প্রিয় একজন লেখক আছে। রোমান লেখক সিসেরোর একটা কথা আছে। যে বেঁচে থাকাটা একটা যোগ্যতা। সব লোক সমান বেঁচে থাকতে পারে না। অসংযত লোক, অনিয়ন্ত্রিত লোক, উচ্ছৃঙ্খল লোক দীর্ঘায়ু হয় না। সুতরাং বেঁচে আছে মানেই বুঝতে হবে জীবনের মাঝে কোথাও না কোথাও ভারসাম্য আছে। পরিমিত বোধ আছে এবং জীবনকে ধারণ করার একটা নিদ্রাহীন চেষ্টা তার মধ্যে আছে। তো মুহিত ভাইয়ের মধ্যে এই যে দীর্ঘায়ু, এটা এমনি না।
অনেকে বলতে পারেন যে আজকে তো মানুষ চেষ্টা করছে যে দেড়শো বছর বাঁচবে। ঠিক আছে আমি মেনে নিলাম যে দেড়শো বছর বাঁচবে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বলছে। এমনও হতে পারে যে ১ হাজার বছর বাঁচবে মানুষ। কিন্তু তাই বলে সবাই কি ১ হাজার বছর বাঁচবে। বাঁচবে না। তখনও ২শ’ বছরে মরার লোক অনেক পাওয়া যাবে। আমাদের বয়স যদি ৩শ’ বছর হতো তবে কি লাভ হতো? তাহলে তো ৬০ বছরে আমরা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হতাম।
আমাদের এক কলেজের হেড ক্লার্ক বলতেন স্যার গাধার আবার বয়স কি? সে ১০ বছরেও গাধা, ৮০ বছরেও গাধা। সুতরাং বয়স দিয়ে কিছু হয় না। যতই বয়স বাড়ুক আমাদের। ১ হাজার বছর পর্যন্ত যাওয়া কঠিন-ই থাকবে। এটা এভারেস্টে যাওয়ার মতোই কঠিন থাকবে।
আমি ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়ি, তখন উনি পাস করে বেরিয়ে গেছেন। তখন তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। দেখা হয়েছে মধ্য বয়সে। যখন উনার বয়স হয়তো ৫০ বছর। আমাদের হয়তো ৪৪ বছর। মুহিত ভাই তখন বুঝতে পারছিলেন না। যে আমি সাহিত্যের লোক। তখন উনি ইআরডির সেক্রেটারি। তার কাছে আমার কি কাজ। কিন্তু টাকা যার কাছে আছে। তার কাছে কাজও আছে। উনি যদি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যান, স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে যান, তখন সেটা হয়তো আমাদের….।
আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী দিয়েই বা কি হবে। কারণ আমি এই স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়টাই বিশ্বাস করি না। যেখানে রোগ, ইনজেকশন, ওষুধ, ডাক্তার, পথ্য, মৃত্যু এসবকিছু। সেটা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় হয় কিভাবে? ওটার নাম তো হওয়া উচিত রোগ মন্ত্রণালয়। আর যদি কিছু সম্মান করে বলতে হয়, তবে বলা যায় আরোগ্যমন্ত্রণালয়। কিন্তু স্বাস্থ্য হলে বাঙ্গালীর এই চেহারা থাকে?
তো মুহিত ভাইকে যখন প্রথম দেখলাম। সেই দীর্ঘ দেহি মানুষটা। আমি অবাক হলাম। তখন তাকে সুপুরুষ মনে হলো। আপনারা কেমন বলবেন জানি না। হাদিসে আছে যে সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ-যে তার স্ত্রীর কাছে শ্রেষ্ঠ। এখন আমরা কি কেউ শ্রেষ্ঠ? বলেন বুকে হাত দিয়ে। সুপুরুষ মানে আমি এটা বুঝাচ্ছি না। যে বাংলা সিনেমার নায়কদের মতো সুপুরুষ। অনেক মডেল আছে পুরুষ। নায়ক আছে পুরুষ। তাদের আমার অনেক সময় পুরুষ বলেই মনে হয় না। আমার মনে হয় যে বড় সাইজের একটা নারী। আমাদের এ ভারত উপমহাদেশের সব জায়গাতে একটা নারী প্রাধান্য বেশি। নাচের মধ্যে পুরুষ থাকলে সে পুরুষটার প্রতি করুণা হয়। যে সে এখানে কি চায়। আমাদের সবকিছুতে নারী প্রাধান্য। চেহারার মধ্যেও। যে পুরুষদের চেহারা নারীসুলভ। তারাই হচ্ছে সবচেয়ে সুদর্শণ। কিন্তু ইউরোপে তা না। ইউরোপে পুরুষ মানে পুরুষ। আমার কাছে উনাকে সেই রকম মনে হয়েছে। সমর্থ, সুঠাম ও বলিষ্ঠ। জীবনকে যিনি নানা দিক থেকে ফেস করতে পারেন এবং ধারণ করতে পারেন। তাকে দেখে আস্থা জাগে এবং আশা জাগে। হতে পারে তার সঙ্গে আমার মতের মিল হলো কিংবা হলো না। তাতে কিছুই আশে যায় না।
এই যে আনিসুল হক মারা গেল। তাতে আমি আজও স্বাভাবিক হতে পারি নাই। কারণ আনিসুল হক আমার সঙ্গে প্রায় ৪০ বছর ছিল। আনিসুল হক মানেই আমার কাছে আস্থা। আনিসুল হক মানেই আমার পাশে কেউ আছে।
আমার কিছুদিন আগে হিপের হাড্ডিটা ভেঙ্গে গেল। সেই সময়ে আমার কানের কাছে আমি আনিসের গলার শব্দ শুনলাম। আনিস বলছে যে, স্যার চিকিৎসা নিয়ে ভাববেন না। ও দায়িত্ব আমার। এই যে বলার মানুষটা। ও দায়িত্ব না নিলেও হয়তো কিছুই হবে না। সবকিছু ঠিকঠাক চলবে। কিন্তু এই যে একজন মানুষ পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে যার উপর নির্ভর করা যায়। এটা কিন্তু খুব বড় কথা। মুহিত ভাইয়ের উপর নির্ভর করা যায়।
অনেক আগে ৫০ বা ৬০ এর দশকে পুরানো ঢাকায় একজন যুবক রিক্সায় করে যাচ্ছে। হঠাৎ সে পিছনের দিকে তাকিয়েছে। পিছনের রিক্সায় দুই দুটো সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। তখন পিছনের দিকে কি করে মেয়ে দুটোকে দেখা যায়। বুদ্ধি বের করলো। সে পকেট থেকে সিগারেট ও দিয়াশলাই বের করলো। দিয়াশলাই জ্বালালো। আর রিক্সাওয়ালাকে বল্ল- এই রিক্সা আস্তে চালাও। দেখনা আমি সিগারেট ধরাচ্ছি। কিন্তু রিক্সাওয়ালা থামে না। সে আবার বলছে এই রিক্সা থামো। আস্তে যাও। তো রিক্সাওয়ালা আস্তে করেছে। এরপর পিছনের রিক্সাটা পাশ কাটিয়ে গেছে। সে চোখ ঘুরিয়ে তৃপ্তিসহকারে তাদের দেখেছে। কিন্তু রিক্সা যখন অনেক দূরে চলে গেছে। তখনও সে একটা দীর্ঘাশ্বাসে ওই দিকেই তাকিয়ে আছে। তখন রিক্সাওয়ালা তাকে বলছে যে, সাব বাতাস তো গেল গিয়া। অহন যামু? তো আমাদের বাতাস শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুহিত ভাইয়ের বাতাস যেন শেষ না হয়।
/ আরকে / এআর