বেকারত্ব ঘোচাতে দরকার বেসরকারি খাতের উন্নয়ন: সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশিত : ০৭:৫০ পিএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সোমবার | আপডেট: ০১:১৭ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার
মো. সিরাজুল ইসলাম
একাডেমিক শিক্ষার সর্বোচ্চ সনদ নিয়েও বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে শিক্ষার্থী, চাকরি মিলছে না। স্নাতকোত্তর পাশের পর তিন থেকে চার বছর আবার চাকরির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। অনেকেই কোচিংও করেছেন। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গলদটা আসলে কোথায়? অন্যদিকে দেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের বা জনসংখ্যার বোনাস যুগ অতিবাহিত করছে। যেখানে দেশের বেশির ভাগ মানুষ কর্মক্ষম। কিন্তু কতটা কাজে লাগানো সম্ভব হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য একুশে টেলিভিশন অনলাইন মুখোমুখি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অধ্যয়ন অনুষদের সাবেক ডিন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও একই বিভাগের বর্তমান অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলামের।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর শিক্ষিতের হার বাড়ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্র তত বাড়ছে না। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এ বেকারের সংখ্যা কমাতে দরকার দেশে বেসরকারি খাতকে আরও বেশি এগিযে নেওয়া। বেসরকারি খাতের উন্নয়নে দরকার ‘বেসরকারিখাত উন্নয়ন নীতি’। এটা করা গেলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট কাজে লাগানো সহজ হবে। দেশ উন্নয়নশীল হওয়ার মর্যাদাও ধরে রাখা সহজ হবে।
দুই পর্বের সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব আজ পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশন অনলাইন প্রতিবেদক রিজাউল করিম।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাস যুগ অতিবাহিত করছে দেশ। অথচ সরকারি হিসেবে দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখের বেশি। দেশের এই বিশাল জনশক্তিকে কেন কাজে লাগাতে পারছি না? মূল সমস্যা ও সমাধান কোথায়? কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরও চাকরি মিলছে না?
সিরাজুল ইসলাম: আমাদের দেশে চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু যে পরিমান ছাত্র পাস করে বের হচ্ছে, সেই তুলনায় চাকরির সুযোগ হচ্ছে না। এর কারণ হলো- দেশের বেসরকারিখাতে প্রয়োজনীয় পলিসি না থাকা। চাকরিটা মুলত আসবে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু বেসরকারি খাতে যে ধরনের পলিসি দরকার ছিল, সে ধরনের পলিসি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অর্থাৎ কোপ্রাইভেট সেক্টর ডিভলপমেন্ট পলিসি দরকার। প্রাইভেট সেক্টর সামনে আগাতে গেলে যে বাঁধাগুলো পড়ে সেগুলো সরকারকে দূর করতে হবে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
কারণ বৃহৎ এ শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর সবাইকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া সম্ভব না। সে জন্য সরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বাড়াতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বেসরকারি খাতে চাকরি পাওয়ার উপযোগী করে তুলতে হবে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: জনসংখ্যার বোনাস যুগ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) এর সুযোগ কাজে লাগাতে আমাদের করণীয় কি হতে পারে?
সিরাজুল ইসলাম: ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট কাজে লাগাতে আমাদের ইনকাম জেনারেটিং এক্টিভিটিসগুলো বাড়াতে হবে। যেমন আমাদের দেশে বিভিন্ন এনজিও আছ। তারা গ্রাম পর্যায়ে হ্যান্ডিক্রাফ্ট ও নকশি কাঁথাসহ নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে নারীদের কাজে লাগায়। সেখানে কিন্তু সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ রয়ে গেছে। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বাড়াতে হবে। তাতে এ ধরনের শিক্ষিত যুব সমাজকে কাজে লাগানো চেষ্টা করতে হবে। তবেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট কাজে লাগানো যেতে পারে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: আমাদের দেশে এতো শিক্ষিত যোগ্য লোক, অথচ পোশাক শিল্পসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় বিদেশি এক্সপার্টদের বেশি বেতনে আনা হচ্ছে। কেন আমরা সে জায়গাটা নিতে পারছি না?
সিরাজুল ইসলাম: আমাদের দেশে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পে ম্যানেজমেন্ট লেভেলে চাকরির জন্য মূলত শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন ও কোরিয়া থেকে আসে। কারণ আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা বাইরের এসব লোকদের বেশি পছন্দ করে। দুটি কারণে তারা বাইরের এসব ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়। প্রথমটি হলো- বাইরের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। দ্বিতীয় হলো- বাইরের লোকজন তাদের বিভিন্ন ধরনের যুব এক্সপেরিয়েন্স নিয়েই তারা আসছে। তাদের দিয়ে কাজটা অনেক সহজ হয়। কিন্তু আমাদের দেশের লোকজনকে এই লেভেলে নিলে বিভিন্ন ধরনের পলিটিক্স ঢুকে যায়। যেখানে বিভিন্ন ধরনের গ্রুপের সুবিধা কাজ করে।
তাই আমাদের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ ধরনের ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট দরকার। আমাদের আছে যেমন বিএমডিসি ও বিআইবিএম। এ ধরনের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আরও বেশি দরকার। সেখানে আমাদের ছেলে-মেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে তারাই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট লেভেলে চাকরি পাবে। তখন বিদেশিদের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
সিরাজুল ইসলাম: চাকরির বাজার আসলে কি ধরনের দক্ষ লোক চায়। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি ধরনের গ্রাজুয়েট প্রডিউস করছে? এ দু’টার মধ্যে কোন সমন্বয় বা সমতা নেই। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ। এখানে আমরা আমাদের নিজস্ব আঙ্গিকে সিলেবাস তৈরি করি। জব মার্কেটে ন্যাশনাল ব্যাংক কি চায়। প্রাইম ব্যাংক কি চায়। বেসরকারি অন্য প্রতিষ্ঠান কি ধরনের দক্ষ লোক চায়। সেদিকে আমাদের নজর নেই।
অপরদিকে প্রত্যেকটা প্রাইভেট ভার্সিটি তাদের সিলেবাস নিজেস্ব আঙ্গিকে তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাহিদা অনুযায়ী সিলেবাস তৈরি করে। তাদের সিলেবাসের বিষয়গুলো ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে একটা যোগসূত্র থাকে। ফলে সেখানে ছেলে-মেয়েরা লেখা-পড়া শেষের সঙ্গে সঙ্গে কোথাও না কোথাও চাকরির সুযোগ নিতে পারে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিলেবাসের সঙ্গে ইন্ডস্ট্রির চাহিদার কোন মিল নেই। ফলে গ্রাজুয়েট কমপ্লিট করার পরও তাদের বেকার থাকতে হয়। সিলেবাস চাহিদা অনুযায়ী না হওয়ার কারণে ছাত্রদের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা কাজ করে। কোনটা নিয়ে পড়বে আর কোনটা নিয়ে পড়বে না। এ জন্য দেখা যায় একজন ছাত্র এসএসসি পর্যন্ত হয়তোবা বিজ্ঞান শাখায় পড়লো। এসএসসি পাসের পর দেখা যায় সে বিজ্ঞান বাদ দিয়ে মানবিকের কোন সাবজেক্ট নিয়েছে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: শিক্ষাকে কর্মমুখী করতে আমাদের করণীয়টা আসলে কি হতে পারে?
সিরাজুল ইসলাম: আমাদের শিক্ষার একটি বড় অংশই কর্মমুখী নয়। কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে প্রয়োজন শিল্প উদ্যোক্তাদের মতামত নেওয়া। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানতে হবে তাদের কি ধরনের লোক দরকার। সিলেবাসে কি কি হলে আপনাদের সঠিক দক্ষতাসম্পন্ন লোক দিতে পারি। যেমন আমাদের মেডিকেলগুলোতে নার্সের ব্যাপক চাহিদা আছে। সে কারণে কেহ নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে বেকার থাকে না।
আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাজারমুখী সাবজেক্ট পড়ানো হয়। বিবিএ এমবিএসহ চাকরির চাহিদা সম্পন্ন মেজর সাবজেক্টগুলো এখানে পড়ানো হয়। এ রকম আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মার্কেট ওরিয়েন্টেড সাবজেক্ট হলো শিক্ষার্থীদের বেকার থাকতে হতো না। তাহলে সমস্যা অনেকটা সমাধান হয়ে আসবে।
অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিভালপমেন্ট প্রসেসে যেভাবে ইন্ডাস্ট্রিগুলো হওয়া উচিৎ। সে প্রকৃয়া খুব ধীর গতির। আমাদের কৃষিক্ষেত্রকে আরও ম্যাকানাইজ করতে হবে। তাহলে শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কৃষিতেও কাজ করার সুযোগ থাকবে। তারা কৃষিতে তারা লেবারের কাজ করবে না। তারা ম্যাশিনের কাজ করবে। ফুড প্রসেসিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে সফিস্টেকেটিড ওয়েতে কাজ করতে পারবে। এভাবেই আমাদের কৃষি ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলে আমুল পরিবর্তন আনতে পারলে চাকরির সুযোগ বাড়বে।
একুশে টেলিভিশন অনলাইন: স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ হয়েছে। এখন বাংলাদেশকে ৬ বছর পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। পর্যবেক্ষণের সময় উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেতে গিয়ে আমাদের কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হতে পারে?
সিরাজুল ইসলাম: উন্নয়নশীল দেশ এক দিনে হয়নি। এটা অনেক দিনের ফসল। এটাকে সামনে নিয়ে যেতে গেলে অর্থনীতির সব খাতকে চাঙ্গা করতে হবে। আমাদের শেয়ারমার্কেট, হাউজবিল্ডিং, রফতানি, বিনিয়োগ, পণ্যের উৎপাদন সবকিছু বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। এসবগুলো নজরে রাখলে আমাদের উন্নয়নশীল হওয়াটা টেকসই ও অর্থবহ হবে।
এসএইচ/