যে কারণে জন্মনিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি বন্ধ্যাকরণ
বিবিসির বিশ্লেষণ
প্রকাশিত : ০৮:৪৯ এএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার | আপডেট: ১১:২২ এএম, ২৭ অক্টোবর ২০১৮ শনিবার
ভারতে ছত্তিশগড়ের এক নারী রাজী কেভাত। ২০১৪ সালে তার শরীরে ছোটখাটো একটি অপারেশন করা হয়েছিল যাতে তিনি আর মা হতে না পারেন।
ফেলোপিয়ান টিউবটিকে কোন এক জায়গায় আটকে দিয়ে করা এই অপারেশনকে বলা হয় লাইগেশন। নারীর বন্ধ্যাকরণের জন্যে এটাই সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি।
ভারতীয় সরকারের প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি লাইগেশন করিয়েছিলেন। নিজের শরীরে অপারেশন করিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, তার এক ননদ শিব কুমারী কেভাতকেও তিনি এজন্যে উপদেশ দিয়েছিলেন।
শিব কুমারীসহ ৮২ জন নারী তখন বিলাসপুর শহরের একটি হাসপাতালে জড়ো হন এই অপারেশন করাতে। একটি মাত্র সরঞ্জাম দিয়েই তাদের সবার অপারেশন করেন চিকিৎসক।
এমনকি এই অভিযোগও উঠেছে যে একজনের অপারেশন শেষ করে তিনি যখন আরেকজনকে অপারেশন করতে গেছেন তখন তার হাতের গ্লাভসও পরিবর্তন করেননি।
তারপর এই নারীদেরকে রাখা হয়েছিল হাসপাতালের মেঝেতে। ওই রাতে প্রচণ্ড বমি শুরু হলো শিব কুমারীর। তার পেটেও শুরু হলো তীব্র ব্যথা। তার কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি মারা গেলেন।
সরকারি কর্মকর্তারা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নানা কিছু বোঝাতে চেষ্টা করলেন। ভেজাল ওষুধকে দায়ী করলেন তারা। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গেল শিব কুমারীর মৃত্যুর কারণ সেপটিসেমিয়া বা রক্তের দূষণ।
সম্ভবত অপারেশনের সময় ইনফেকশন বা সংক্রমণের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। ওই ক্যাম্পে যে সব নারীর লাইগেশন করা হয়েছিল তাদের মধ্যে তখন যে ১৩ জনের মৃত্যু হয় তাদের একজন এই শিব কুমারী।
তারপরেও, রাজী কেভাত বলেন, কেউ যদি তাকে বন্ধ্যাকরণের কথা বলেন, তিনি লাইগেশন করানোর কথাই বলবেন। তার কারণটাও খুব সোজা। ‘যদি এটা না করান, আপনার পরিবার অনেক বড় হয়ে যাবে,’ বলেন তিনি।
রাজী কেভাতের মতো বিশ্বের বহু নারীর কাছে এটাই জন্মনিরোধের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি। সারা বিশ্বেই নারীদের পছন্দের তালিকায় এটা এক নম্বরে।
পশ্চিম ইউরোপ, কানাডা অথবা অস্ট্রেলিয়ায় এজন্যে নারীরা খাবারের বড়িই পছন্দ করেন কিন্তু এর বাইরে বিশ্বের অন্যত্র জনপ্রিয়তায় এগিয়ে লাইগেশনের মাধ্যমে বন্ধ্যাকরণ। বিশেষ করে এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে এবং ল্যাটিন আমেরিকায়।
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১৫ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, সারা বিশ্বে বিবাহিত নারী কিংবা যারা যে কোনও ধরনের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে আছে, গড়ে তাদের প্রায় ১৯ শতাংশ বন্ধ্যাকরণের এই পদ্ধতির উপর নির্ভর করেন।
জনপ্রিয়তার দিক থেকে তারপরে রয়েছে আই ইউ ডি, ১৪ শতাংশের কম নারী এটা পছন্দ করেন। এই পদ্ধতিতে গর্ভধারণ ঠেকানোর লক্ষ্যে নারীর জরায়ুর ভেতরে একটি যন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপরেই রয়েছে খাবার ওষধ, ৯ শতাংশ নারী।
তবে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় ভারতে। সেখানে বিবাহিত নারীদের প্রায় ৩৯ শতাংশ এই পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল, যা বিশ্বের গড় হিসেবের প্রায় দ্বিগুণ।
সারা বিশ্বেই যে সব নারী সন্তান নিতে চান না, কিংবা যে সব মা মনে করেন যে তাদের আর সন্তানের দরকার নেই তাদের জন্যে বন্ধ্যাকরণই নিরাপদ ও কার্যকর পদ্ধতি বলে তারা মনে করেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন হওয়া মায়েদের অনেকেই সন্তান জন্মদানের পরপরই এই পদ্ধতিকে গ্রহণ করেন কিন্তু বাকিরা যারা কনডম কিংবা খাবার বড়ির মতো অস্থায়ী পদ্ধতি ব্যবহার করতেন, পরিবারের সদস্য সংখ্যা যথেষ্ট হয়ে যাওয়ার পর তারাও বন্ধ্যাকরণ পদ্ধতির দিকে চলে যান।
এর ভাল দিক হচ্ছে, এই নারীদেরকে আর কখনোই জন্মনিরোধের পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে হবে না এবং একবার এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর তার শরীরে কোন ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি হবে না।
কিন্তু ছত্তিশগড়ের মতো ভারতে যেটা হয়েছে যে সেখানে বহু নারীই এই পদ্ধতির তাৎপর্য পুরোপুরি না বুঝেই সেটা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও যেভাবে ও যে পরিবেশে এটা করা হয়েছে সেটাও নারীর জীবনের জন্যে নিরাপদ নয়।
বিলাসপুরে শিব কুমারীর বাড়ির খুব কাছেই একটি হাসপাতালের পরিচালক ইওগেশ জৈন বলেছেন, ‘এখানে যে ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটেছে সেটা হওয়ারই কথা।’ তিনি মনে করেন দরিদ্র নারীদের জন্যে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তাতে তাদের মৃত্যু অবধারিত। এ সব নীতিতে নারীদেরকে একটি জরায়ু কিংবা এক জোড়া হাতের চেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয়নি।’
ছত্তিশগড়ের বন্ধ্যাকরণ ক্যাম্পে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেগুলো তদন্ত করে পপুলেশন ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া দেখেছে, বন্ধ্যাকরণের চিকিৎসাগত প্রক্রিয়ার পেছনে যতো অর্থ খরচ হতো রাজ্য সরকার এই পদ্ধতি গ্রহণের ব্যাপারে নারীদেরকে উৎসাহিত করতে তারচেয়ে ২০ গুণ বেশি অর্থ খরচ করতো। এজন্যে প্রত্যেক নারীকে দেওয়া হতো ৬০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ রুপী।
কিন্তু ২০১৪ সালের ট্র্যাজেডির পর কেন্দ্রীয় সরকারও স্বীকার করে নেয় যে এই অপারেশনের গুণগত মান ছিল খুবই খারাপ। সেকারণে পপুলেশন ফান্ড অফ ইন্ডিয়া ক্যাম্প বসিয়ে বন্ধ্যাকরণের কর্মসূচি নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছিল এবং ভারত সরকারও তাতে সম্মত হয়।
তারপর থেকে এই কর্মসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এখন বন্ধ্যাকরণে আগ্রহী নারীদেরকে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনগুলোতে নির্দিষ্ট একটি স্থানে যেতে হয়। ফলে অপারেশন যেভাবে হয় এবং যেখানে হয় তার মান আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে। এবং কর্তৃপক্ষও এসবের উপর নজর রাখতে পারে। তবে ভারতের অনেক জায়গাতেই নির্ধারিত এই সময় ও স্থান চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়।
যেমন বিলাসপুর থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে মুঙ্গেলি জেলার একটি হাসপাতালে মাত্র একজন চিকিৎসক সপ্তাহে দু`দিন বন্ধ্যাকরণের কাজটি করেন। এই দু`দিনে মাত্র ২০টি অপারেশন করতে পারেন তিনি। কিন্তু ওই জেলার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, আগ্রহী নারীদের তুলনায় এই সংখ্যা খুবই কম।
অতীতের কলঙ্কজনক ইতিহাস সত্ত্বেও ছত্তিশগড়ের বহু নারীর কাছে এই পদ্ধতি এখনও প্রথম পছন্দ।
কিন্তু এই কাজের প্রক্রিয়া নিয়ে এখনও রয়ে গেছে বিতর্ক। অত্যন্ত নিরাপদ পরিবেশে অপারেশন করার পরেও ভ্যাসেকটমির চেয়েও অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ লাইগেশনের অপারেশন। তারপরেও পুরুষদের তুলনায় নারীরাই এই বন্ধ্যাকরণের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
লাইগেশনের ব্যাপারে নারীদেরকে শুধুমাত্র সম্মতি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে হয় না। কনডম ব্যবহার কিম্বা খাবার বড়ির ক্ষেত্রে যেমন কিছু নির্দেশনা মেনে চলতে হয় লাইগেশনের বেলাতে সেই সমস্যা থাকে না।
কিন্তু একজন নারীর একবার যখন বন্ধ্যাকরণ হয়ে যায় তখন আর তাকে গর্ভধারণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে চিন্তা করতে হয় না। অনেক সময় সরকারও তার সুযোগ নিয়েছে।
পেরুতে ১৯৯০ এর দশকে দরিদ্র নারীদেরকে না জানিয়েই সরকারি চিকিৎসকরা তাদের লাইগেশন করেছেন। বরং এ সময় তারা নারীদের বলেছেন যে তারা তাদের শরীরে ভিটামিন ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
সরকারিভাবে এতো গুরুত্ব দেওয়া এবং এর জনপ্রিয়তার কারণে নারীরা অন্যান্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে চান না। দেখা গেছে, ভারতে যে নারী একবার বন্ধ্যাকরণ করেছেন, তারা তাদের জীবনে এই পদ্ধতি ছাড়া আর কোনও কিছু পদ্ধতি যেমন আই ইউ ডি, প্যাচ কিংবা বড়ি ব্যবহার করেন না। এখানেও একটা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি থেকে যায়। বিরতি না দিয়ে একের পর এক সন্তান গ্রহণের কারণে নারী ও শিশু উভয়েরই মৃত্যুর হার কিংবা অন্যান্য শারীরিক জটিলতা বেড়ে যেতে পারে।
এটাও বলতে হবে যে খাবার বড়ি কিংবা প্যাচের মতো জন্মনিরোধক চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। আই ইউ ডি প্রবেশ করানোর জন্যে প্রশিক্ষিত পেশাজীবীর সংখ্যাও কম। সামাজিক কারণেও এ সব পদ্ধতির ব্যাপারে নারীদের জ্ঞানেরও অভাব রয়েছে।
সূত্র: বিবিসি
এমএইচ/একে/