ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

শাসনের ইতিহাস, ক্ষমতার পালাবদল ও গণতন্ত্রের ঝুঁকি

গোলাম সারোয়ার

প্রকাশিত : ০৩:৫৪ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

আদিপ্রাণ থেকে মানুষের ইতিহাস পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই শক্তিশালী সত্ত্বাই পরিবেশ এবং প্রতিবেশের উপর প্রভাব বিস্তার করে। তারপর মানুষের প্রাথমিক ইতিহাস থেকে সর্বশেষ ইতিহাস পর্যন্তও আমরা দেখতে পাই শক্তিমানের একনায়কত্ব। মানব ইতিহাসের প্রথম দিকে শক্তির উৎস ছিলো গায়ের জোর বা পেশি শক্তি।

ধীরে ধীরে শক্তির উৎস হিসেবে হাতিয়ার, প্রজ্ঞা এবং স্বপক্ষের জনবল যোগ হতে থাকলো। জনবল এবং শক্তিসংঘ যে গোত্রের যতবেশি বড় হতে থাকলো সে গোত্র ততবেশি ভূখন্ডের উপর আদিপত্য বিস্তার করতে থাকলো। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকলো প্রতিষ্ঠান। মানব ইতিহাসের সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হলো রাষ্ট্র। আর আধুনিক রাষ্ট্রের সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হলো রাজনৈতিক দল।

মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাসের তুলনায় রাষ্ট্রের ইতিহাসের বয়স অনেক কম। সে কমও কিন্তু একেবারে কম নয়। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে নগর রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। তখন অবশ্য রাষ্ট্রের সব মানুষকে নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতোনা। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে প্রাচীন গ্রীসের স্পার্টায় ৩০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের পুরুষদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। রাষ্ট্র পরিচালনা কে করবে সে প্রতিনিধি নির্বাচনের বেলায় গ্রীসের এথেন্সে এপেলা নামক একটি মাসিক জনসমাবেশ হতো। জনগণ চিৎকার করে কিংবা নাম্বার দিয়ে কোন প্রতিনিধির পক্ষে সমর্থন জানাতো। এই পদ্ধতি কিন্তু এরিস্টটল মানেননি। তিনি এর কঠোর সমালোচনা করেন।   

রোমান সাম্রাজ্যকালে এবং বিস্তারে পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম সাম্রাজ্যসমূহের একটি। প্রায় ৮০০ বছর টিকে থাকা এই সাম্রাজ্য ইউরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। সেই রোমান সাম্রাজ্যে জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশকে নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর সামন্ততন্ত্র বিকশিত হতে থাকলো। সামন্তপ্রথায় ভূমির মালিক সামন্তরাজা। প্রজারা অর্থ কিংবা ফসলের বিনিময়ে জমি চাষ করতো। ইউরোপে ১১০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় মধ্যযুগ। এই সময়ে ইউরোপের বেশির ভাগ অঞ্চল শাসন করতো সামন্তরাজারা। অবশ্য সামন্তপ্রথা নিরেট মধ্যযুগেরই উদ্ভাবন নয়। প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়ায় সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিলো। ৫০০০ থেকে ৩২০০ খ্রিস্টপূর্ব সময় পর্যন্ত মিশর ত্রিশ থেকে চল্লিশটি সামন্তরাজ্যে বিভক্ত ছিলো। এগুলোকে বলা হতো নোম। প্রতিটি সামন্তরাজ্যের এক একজন সামন্তরাজা ছিলো। ৩২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মিনেস নামের একজন রাজা সমগ্র মিশরকে একরাজ্যে পরিণত করেন। তারমানে সামন্তপ্রথাও মূলত প্রাচীন একটি প্রথা। আসলে মানব সভ্যতার ইতিহাস বহুমাত্রিক এবং বৈচিত্রময়। এক একটি সভ্যতা এক একভাবে বিকশিত হয়েছে। পৃথিবীর সব সভ্যতাকে একটিমাত্র রূপরেখায় ব্যাখ্যা করা চলেনা। তবে একটি ব্যাখ্যা অবশ্য চলে, আর তা হলো, চেক এন্ড ব্যালেন্স না থাকলে যেসভ্যতা থেকেই উদ্ভব হোকনা কেন, যেকোন যুগের যেকোন নৃপতিই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেন। তাই শাসনে চেক এন্ড ব্যালেন্স লাগে।

বলছিলাম মধ্যযুগের কথা। মধ্যযুগে সামন্তপ্রভুরা ছাড়াও ক্ষমতার আরো একটি কেন্দ্র ছিলো। আর তা হলো গির্জা। মধ্যযুগ শাসন করেছে সামন্তপ্রভু আর পাদ্রিরা। মধ্যযুগের সামন্তপ্রথাকে পরাজিত করে ইউরোপের রেনেসাঁ আর আর ক্যাথলিক চার্চের অত্যাচার রূখে দাঁড়াতে উদ্ভব হয় প্রোটেস্টান্ট ধর্মের। আর সম্মিলিত মানবসমাজের মুক্তি এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। তবে মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি এখনো অনেক দূর। এখনো পৃথিবীতে রাজতন্ত্র আছে, স্বৈরতন্ত্র আছে, আছে ধর্মতন্ত্র ও লোকরঞ্জনতন্ত্র এবং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র।

বিংশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীতে দুই ধরণের রাজনৈতিক দর্শন জনপ্রিয়তা পায় এবং পরস্পর সংঘাতেও জড়িয়ে যায়। তার একটি হলো সমাজতন্ত্র, আরেকটি হলো গণতন্ত্র। এগুলো মূলত দুটি অর্থনৈতিক দর্শনকে কেন্দ্র করে বলয় সৃষ্টি করে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পক্ষে সাম্যবাদ আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পক্ষ হলো গণতন্ত্র। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আয় বৈষম্য খুবই কম। তবে সমাজতন্ত্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়, মৌলিক অধিকার হয় নিয়ন্ত্রিত, প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকেনা। নিয়ন্ত্রিত বলে মুক্তজ্ঞান, সৃজনশীলতা, সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, প্রগতি হয় ধীরে ধীরে হয় পঙ্গু। প্রতিযোগিতার অভাবে অর্থনীতি বিকশিত হয়না। মানুষের ইতিহাস যেহেতু নিয়ম ভেঙ্গে নিয়ম গড়ার ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস যেহেতু ছাড়িয়ে যাওয়ার ইতিহাস, রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙ্গার ইতিহাস, সেহেতু সমাজতন্ত্রে মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে সভ্যতার বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত হয় । তাই সমাজতন্ত্র টিকলো না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতাকা খসে পড়তে থাকলো।

বাকী থাকলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক দর্শনকে মদত দেয় গণতন্ত্র। বর্তমানের প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শক্তিমানরা লাভবান হয়। এখানে অধিকার ভোগের বাড়াবাড়ি আছে, আছে মানবাধিকারের বাড়াবাড়ি। এখানে পুঁজিপতিদের মুনাফা বাড়ানোর বাড়াবাড়ি সমাজে বৈষম্য প্রকট থেকে প্রকটতর করেছে। এর কারণ হলো প্রচলিত ব্যবস্থায় চেক এন্ড ব্যালেন্স নেই। সঠিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা এখন আরো ব্যাপক হতে হবে। এটি হবে মূলত কল্যানমুখী রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রচেষ্টা। কল্যান রাষ্ট্র ধনীদের থেকে বেশি কর আদায় করে গরীবদের সহায়তা করবে। কারণ সব মানুষ সমানভাবে আয় করতে পারেনা। কিন্তু দেশটি সবার। কল্যান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্রটির ব্যবস্থা হতে হবে কল্যানময়, সুদৃঢ়, সুসংহত। যে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা পালাবদলের ব্যবস্থা নিয়মতান্ত্রিক নয়, যেখানে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে আর ক্ষমতায় থাকার জন্যে রাজনৈতিকদলগুলো যেকোন রকমের অনৈতিকতায় আশ্রয় নেয় সে রাষ্ট্রকে কল্যান রাষ্ট্র বানানো কঠিন।

২০০৬ সাল থেকে ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনোমিস্টের ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর গণতন্ত্রের র‌্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। তাদের বিবেচনায় বিশ্বের ৩৪ শতাংশ মানুষ এখন স্বৈরশাসনে জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু আমরা জানি, যে মানুষগুলোকে গণতান্ত্রিক শাসনে জীবন কাটাচ্ছে ধরা হয়েছে তারাও প্রকৃত গণতান্ত্রিক জীবনে আসলে নেই। কারণ ২৫১ বছরের পুরোনো আমেরিকার গণতন্ত্রের অবস্থাও এখন নাজুক।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর অভিযোগ উঠে যে, ক্যামব্রিজ এনালাইটিকা নামের একটি কোম্পানী যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের গণভোটকে সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রভাবিত করেছে। তারা ফেজবুকের মতো সামাজিক উৎসগুলো থেকে তথ্য আহরণ করে এবং সেগুলো ব্যবহার করে মানুষকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে একপক্ষের প্রতি প্রণোদিত করেছে কিংবা আরেক পক্ষের প্রতি বিমুখ করেছে। এই অভিযোগ প্রথম উঠে সুইস পাবলিকেশন ডাস ম্যাগাজিনে। অনেকে এই গল্প বিশ্বাস করেছে, অনেকে করেনি। আবার যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়ার প্রভাব নিয়েও বিস্তর অভিযোগ আছে যা এখনো তদন্ত চলছে। তারমানে গণতন্ত্রের উপর নতুন করে সওয়ার হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাব। আর পেশি শক্তির প্রভাবতো সেই প্রাচীনকাল থেকে আছেই।  

প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, গণতন্ত্র এক ধরনের শাসনব্যবস্থা, যেখানে শাসনক্ষমতা কোনো শ্রেণি বা শ্রেণিসমষ্টির ওপর ন্যস্ত থাকে না, বরং তা সমাজের সদস্যদের ওপর ন্যস্ত থাকে। আর অ্যারিস্টটলের মতে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধনী মানুষের চেয়ে গরিব মানুষের ক্ষমতা হবে বেশি, কেননা তারা সংখ্যায় বেশি। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাই  প্রাধান্য পাবে। তবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের গণতন্ত্রের বর্তমান হালহকিকত পাওয়া যাবে হিনস হাও’য়ের গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দৃষ্টিতে গণতন্ত্র বলতে এমন এক মতবাদকে বোঝায়, যেখানে জনগণ রাষ্ট্রকে তার ইচ্ছামতো এমন এক জবরদস্তি শক্তি সংগ্রহ করে দেয়, যার আনুগত্য করতে ভূখণ্ডের সব মানুষ বাধ্য থাকবে। এখন অবশ্য গণতন্ত্রের অবস্থা আরো খারাপ। এখন জনগণেরও ম্যান্ডেট দিতে হয়না বহু গণতান্ত্রিক দেশে।  

যে রকমেরই হোক আমাদের রাষ্ট্রও চলে গণতান্ত্রিক কায়দায়। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, রাষ্ট্র মধ্যম আয়ের পথ পাড়ি দিয়ে উন্নতির দিকে যাত্রা করেছে, অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য আছে। কিন্তু আমাদের এখনো বড় সমস্যা হলো আমাদের রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটা এখনো যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন তারা মানেন না। এই না মানা কোন ভালো কথা নয়। এটা গণতন্ত্রের ঝুঁকি। আমরা উন্নতির স্বর্ণশিখরে উঠে গেলাম তারপর দশ বিশ বছর পর রাজনৈতিক ভূমিকম্পে সবকিছু মিসমার হয়ে গেলো, তেমন ব্যবস্থা নিশ্চয় টেকসই কোন ব্যবস্থা নয়। গণতন্ত্রের বহু সমালোচনা আছে। ভোট ব্যবস্থার কারসাজী পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করার ক্ষমতা সমস্ত বিশ্বেরই এখনো সীমিত। এসব বাস্তবতা মাথায় রেখেও আমরা আশা করবো ক্ষমতা হস্তান্তর হবে একটি বিধিবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর মানুষ নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে এসে বিশ্বাস করবে তার ভোটটি গণনা করা হয়েছিলো, সেও অবদান রেখেছিলো রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শাসক নির্ধারণে।

 

লেখক: গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।