ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা কমায় মোবাইল ফোন

ডা. উম্মে সালমা

প্রকাশিত : ০৬:৩১ পিএম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বুধবার | আপডেট: ১১:০৭ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ বৃহস্পতিবার

বর্তমান যুগ তথ্য প্রযুক্তির যুগ। তথ্য-প্রযুক্তি খাতে চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আবিষ্কারের মাধ্যমে। মোবাইল ও ইন্টারনেটের ব্যবহার দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করেছে।

পারষ্পরিক যোগাযোগ, চাকরি ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষাখাতে গতি এনেছে এবং শিল্প সাহিত্যের বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। দূরত্বের বাধা অতিক্রম করে গোটা বিশ্বকে নিয়ে এসেছে হাতের মুঠোয়।

তবে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও আছে। মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে আমাদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই সচেতন নই।

মোবাইল থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত হচ্ছে এক ধরনের বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ যাকে বলা হয় মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েশন। এই রেডিয়েশন আপাতদৃষ্টিতে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের শরীরের বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে এই রেডিয়েশন বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

কমিয়ে দেয় পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা: পুরুষরা যারা রোজ দীর্ঘ সময় মোবাইল ব্যবহার করে এবং শরীরের সংস্পর্শে বিশেষ করে প্যান্টের পকেটে ফোন রাখে তাদের ক্ষেত্রে শুক্রানুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় (৩০ শতাংশ) কমে যেতে পারে। যার ফলে তাদের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।

হ্রাস পাবে শ্রবনশক্তি: পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল এডুকেশন এন্ড রিসার্চ ইন চন্ডিগড়, ইন্ডিয়ার পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১২৫ জন ব্যক্তি যারা বিগত এক বছর ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন তাদের তুলনা করা হয়েছে ৫৮ জন ব্যক্তির সঙ্গে যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। পরীক্ষা নীরীক্ষা করে দেখা গেছে, মোবাইলফোন ব্যবহারকারীদের শ্রবনশক্তি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।

গবেষকদের মতে যারা রোজ ৬০ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বলেন তাদের ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে শ্রবনশক্তি হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশী।

মোবাইল ফোন ব্যবহারে মস্তিষ্কে টিউমার বা ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি: একজন ব্যক্তি যখন ১০ মিনিট মোবাইল ফোনে কথা বলে বিশেষ করে কানের সঙ্গে চেপে ধরে, সেই অবস্থায় মোবাইল ফোনের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি আমাদের শরীরের সংবেদনশীল অংশ বিশেষ করে কান, চোখ, নাক এবং মস্তিষ্কের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিন সায়েন্স তাদের সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দাবি করেছে যে, দশ বছর ধরে নিয়মিত মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে মস্তিষ্কে টিউমার বা ক্যান্সার হওয়ার প্রবনতা ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

শিশুদের মস্তিষ্কের ক্যান্সার, টিউমার ও দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পেতে পারে: মোবাইল ফোন ব্যবহারে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকিতে আছে শিশুরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে মোবাইলের রেডিয়েশন ক্লাস টু বি কারসিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যান্সার সৃষ্টি করার সম্ভাবনা তৈরি করে। যেহেতু শিশুদের মাথার খুলি বড়দের তুলনায় অনেক পাতলা তাই বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ বা রেডিয়েশন তাদের মস্তিষ্কে দ্রুত প্রবেশ করতে পারে। শিশুরা বড়দের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি রেডিয়েশন গ্রহণ করছে ( যারা দীর্ঘসময় মোবাইল নিয়ে খেলছে বা কথা বলছে)। যার ফলে তাদের মস্তিষ্কে টিউমার হওয়ার সম্ভাবনা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি।

এছাড়া দীর্ঘসময় মোবাইল বা কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে শিশুদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে সম্প্রতি অনেক শিশুকে চশমা ব্যবহার করতে দেখা যায়। অনেক অভিভাবকরা শিশুদের হাতে খেলনা হিসেবে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু এর ফলে শিশুরা কী পরিমাণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে তা সম্পর্কে বাবা মায়ের কোনো ধারনাই নেই। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে গর্ভস্থ শিশু: গর্ভবতী নারীদের গর্ভস্থ ভ্রুনের উপর মোবাইলের রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। একজন গর্ভবতী নারী দীর্ঘসময় মোবাইল, ইন্টারনেট ব্যবহার করলে গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং ভবিষ্যতে এই শিশুদের মধ্যে জন্মগত ত্রুটি, আচরণগত ত্রুটি, অস্থিরতা, মনোযোগের অভাব পরীলক্ষিত হতে পারে।

শিশু-কিশোরদের আচরণে প্রভাব: বর্তমান বিশ্বে মোবাইল ব্যবহারকারী ৮০% মানুষই মোবাইলে আসক্ত। শিশু কিশোরদের মধ্যে এই প্রবনতা অনেক বেশি। এই মোবাইল আসক্তি শিশুদেরকে পড়ালেখায় অমনোযোগী, জেদী ও আক্রমনাত্মক স্বভাবে করে দিতে পারে।

এছাড়া মোবাইল ব্যবহার করার ফলে যে সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে সেগুলো হল- মাথাব্যথা, ঘুমের সমস্যা, ক্লান্তিবোধ করা, মনোযোগ কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া, বিষন্নতা ইত্যাদি। এছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে সড়ক দূর্ঘটনা।

লেখক : ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ, বারডেম হাসপাতাল।

অনুলিখক: আলী আদনান

অা অা/ এআর